২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রথম মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অপেক্ষায় দেশ। প্রতিটি মুহূর্ত সে কী উত্তেজনা। ক্ষণে ক্ষণে মোবাইল ফোনে আসছে এসএমএস। বলা হচ্ছে, এই মুত্যদণ্ড কার্যকর হলে দেশে গৃহযুদ্ধ হবে। কে পাঠাচ্ছে এই বার্তা জানার, বোঝার উপায় ছিল না। তবে আতঙ্ক ছড়াচ্ছিল এসব বার্তা।
পরে কার্যকর হলো রায়। আর পরদিন জামায়াত শিবিরের সে কী প্রতিক্রিয়া। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়ার চেষ্টা দলের কর্মীদের। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নাশকতার আগুনে পুড়েছে মানুষের জীবন, সম্পদ।
এরপর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলো। সরকারের কঠোর মনোভাব আর আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযানের কারণে ধীরে ধীরে শক্তি হারালো জামায়াত। একে একে মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মতিউর রহমান নিজামী এবং সবশেষ মীর কাসেম আলীর দণ্ড কার্যকর হলো। যে দলের নেতা-কর্মীরা বিশ্বাস করতো না মানবতাবিরোধী অপরাধীদের দণ্ড সরকার আদৌ কার্যকর করতে পারবে, যারা রাজপথে এই দণ্ড কার্যকর ঠেকিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল, সেই দলটির নেতা-কর্মীরাই ধীরে ধীরে চুপসে যেতে থাকে।
এর আগে প্রতিটি রায় কার্যকরের পর জামায়াত একাধিক দিন হরতাল দিলেও মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায়ের দুই দিন পর দিয়েছে আধাবেলা হরতাল।
এর আগে এই মানবতাবিরোধী অপরাধীর রিভিউ আবেদন নাকচ হয়ে যাওয়ার পর দলটি সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকলেও জনজীবনে তার কোনো প্রতিক্রিয়াই পড়েনি। নগর পরিবহন তো বটেই নজিরবিহীনভাবে দূরপাল্লার গাড়ি, এমনকি বিলাসবহুল বাসও চলেছে অবলীলায়।
জামায়াত দুর্বল হয়ে যাওয়ার পর তাদের হরতালের কর্মসূচিও গণমাধ্যমে আর গুরুত্ব পাচ্ছে না। মোড়ে মোড়ে পুলিশের সশস্ত্র অবস্থানও আর নেই। ঝটিকা মিছিল করে গণমাধ্যমে বার্তা পাঠানোও বন্ধ করেছে জামায়াত।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী মনে করেন, জামায়াত দুর্বল হয়েছে মূলত জনগণের চাপে। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে সরকার ও আদালত দৃঢ়চিত্তের প্রমাণ রেখেছে। এর পেছনে মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে জনগণের ব্যাপক সমর্থন। জামায়াত গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু জনগণ যেখানে ঐক্যবদ্ধ যেখানে কোনো শক্তির পক্ষেই কিছু করার সুযোগ ছিল না।’
সারওয়ার আলী বলেন, ‘অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাতের গবেষণা অনুযায়ী মীর কাসেম আলী প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক। কিন্তু অর্থ দিয়েও যে অন্যায় কিছু করা যায় না সেটা সরকার, আদালত ও জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে প্রমাণ করেছে। জামায়াত ফাঁকা বুলি দিলেও ধীরে ধীরে তারা জনগণের প্রতিক্রিয়ার ভয়েই চুপসে গেছে।’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি বলেন, ‘জামায়াত হয়ত বিচ্চিন্ন কিছু ঘটনা ঘটাতে পারে, গুপ্তহত্যাও করতে পারে, কিন্তু জনগণের সামনে এসে কিছু করার সাহস তাদের নেই। আজকের হরতালও তো তার প্রমাণ।’
পাঁচ নেতার ফাঁসির পর নিষিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা
স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে ইতিমধ্যে দলের পাঁচজন শীর্ষস্থানীয় নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। আরও দুজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন, যা এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। সরকারি দলের নেতারা বলছেন, যেকোনো সময় নিষিদ্ধ ঘোষিত হতে পারে দলটি।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে বলা হয়েছে জামায়াত একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। এ কারণে সন্ত্রাসবিরোধী আইনেই তাদেরকে নিষিদ্ধ করা যায়। আমার ধারণা, এটা সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। এই সিদ্ধান্ত যত দ্রুত আসে ততই মঙ্গল।
নেতাদের পাশাপাশি দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল একবার। তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্তও করেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। কিন্তু ব্যক্তির সাজার কথা নির্দিষ্ট থাকলেও ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে সংগঠনের সাজা নির্দিষ্ট নেই। এ কারণে বিচারের উদ্যোগ থেমে যায়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যে কোনো সময় সেটা চূড়ান্ত হলে জামায়াতের বিচারও শুরু হবে।
সন্ত্রাসবাদের তকমা
জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধীতা এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে অস্ত্র ধরে হত্যা, গণহত্যা, লুটপাটে অংশ নেয়ার কাহিনি অজানা নয় কারও কাছেই। এই অপরাধে মুক্তিযুদ্ধের পর নিষিদ্ধ হয় দলটি। আত্মগোপনে যান দলের নেতারা।
পরে ৭৫ এর পট পরিবর্তনের সুযোগে জামায়াত নেতারা আবার প্রকাশ্যে আসেন, গঠন করেন রাজনৈতিক দলটি। ধীরে ধীরে অর্থবিত্তে ফুলে ফেঁপে উঠা দলটি নানা কৌশলে আরও বড় হয়ে উঠার চেষ্টা করে। স্বপ্ন দেখে ক্ষমতায় আরোহনের।
বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ২০০১ সালে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার পর জঙ্গি তৎপরতায় জামায়াত কর্মীদের অংশগ্রহণের নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়। ওই সরকারের আমলে উত্তরাঞ্চলে তোলপাড় তোলা জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ-জেএমবিতে জামায়াত-শিবিরের সাবেক বহু কর্মীর অংশগ্রহণের প্রমাণ পাওয়া যায়। গণমাধ্যমে এই খবর প্রকাশ হলে জামায়াত তখন বিবৃতি দিয়ে জানায়, এসব কর্মীদেরকে তারা বহিষ্কার করেছে।
সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতাতেও জামায়াত সম্পৃক্ততার অভিযোগ করেছে সরকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানিয়েছেন, গত দুই বছরে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত খাবার অভিযোগে যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের বেশিরভাগই জামায়াত-শিবিরের বর্তমান বা সাবেক কর্মী।
এর আগে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সারাদেশে জ্বালাও-পোড়াও আর সাধারণ মানুষের ওপর পেট্রলবোমা হামলার ঘটনায় দেশ বিদেশে সমালোচিত হয়েছে দলটি। প্রকাশ্যে এসব অভিযোগ অস্বীকার করলেও জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির এক দিনে সাড়ে পাঁচশ এলাকায় নাশকতার কৃতিত্ব দাবি করে বিবৃতিও পাঠিয়েছিল গণমাধ্যমে। আর সে সময় জামায়াত নেতা আবদুর রাজ্জাক যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করে এসে নাশকতায় নিজের কর্মীদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে ব্যাখ্যাও দিয়ে এসেছিলেন।
জামায়াত অস্বীকার করলেও তাদের কর্মীদের গায়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের তকমা লেগেই আছে। দলটির বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে নেতাকমীরা দিশেহারা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, কোনো বিষয়ে কথা বলার জন্য খোঁজ করেও পাওয়া যায় না দলের কোনো স্তরের নেতাকর্মীকে। এমনকি দলের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি কার্যকরে প্রতিক্রিয়া জানানোরও কেউ নেই দলটির।
জামায়াতের হুমকি আর বাস্তব চিত্র
অথচ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিচার শুরু হলে এর বিরুদ্ধে তখন ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল জামায়াত-শিবির। জ্বালাও-পোড়াও, পেট্রলবোমার নাশকতা হয়ে উঠেছিল তাদের প্রতিক্রিয়ার অনুষঙ্গ। একে একে দলের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি হলো, আর কমতে থাকল তাদের সেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার তেজ। কমতে কমতে তা এখন প্রায় শূন্যের কোটায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একে দেখছেন ইতিবাচক হিসেবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম রায় হয় জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার। রায় ঘোষণার দিনই হরতাল পালন করে জামায়াত। রায় বিরুদ্ধে গেলে মেনে নেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে আগেভাগেই দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতা শুরু করেছিল দলটি। রায়ে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
এর রায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে দেশজুড়ে শুরু করে গণ-আন্দোলন। একই সময় রায়ের প্রতিবাদে হরতাল ও নাশকতা চালু রাখে জামায়াত।
ট্রাইব্যুনালে আরেক নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর জামায়াত দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে তাণ্ডব চালায়, তা ছিল দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। পুলিশের ওপর আক্রমণ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট চালিয়ে দেশে এক ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল তখন।
পরে আপিলে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বদলে ফাঁসির আদেশ এবং দণ্ড কার্যকরের পরও চালু থাকে একই ধরনের নাশকতা।
তবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে নানা নাশকতা করেও সফল না হলে অনেকটা চুপসে যায় জামায়াত। দলের অন্য নেতাদের দণ্ড কার্যকরের পর তেমন কোনো জোরালো প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করতে পারেনি দলটি। সাঈদীর ফাঁসির রায় বা কাদের মোল্লার দণ্ড কার্যকরের পর দেশজুড়ে জামায়াত যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল তার ছিঁটেফোঁটাও দেখা যায়নি দলের অর্থের জোগানদার মীর কাসেম আলীর দণ্ড কার্যকরের দিন।
দলের শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের প্রতিবাদে ২৪ ঘণ্টা হরতাল দিয়েছিল জামায়াত। কিন্তু হরতালে ঢাকার রাস্তায় ছিল যানবাহনের ভিড়। আর দূরপাল্লার গাড়িও চলেছে নিয়মিত। দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের রায় কার্যকরের সময়ও এক দিনের হরতাল দিয়েছিল দলটি। কিন্তু দৃশ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
সাঈদীর ফাঁসির আদেশ, কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের আগে-পরে সাতক্ষীরা, খুলনা, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, রংপুর, নীলফামারী, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লায় ব্যাপক নাশকতা করেছিল। বিশেষ করে বগুড়া, সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সীতাকুণ্ডের পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। কিন্তু গত দুই বছর ধরে এসব জেলাতেও প্রতিক্রিয়াহীন জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকরের পর অতীতের সহিংসতাপ্রবণ এই জেলার নেতাকর্মীরা নীরব।
সব মিলিয়ে কর্মী-সমর্থকরা হতোদ্যম, পরস্পর বিচ্ছিন্ন। ফলে নাশকতার পরিমাণও কমে এসেছে আগের তুলনায়।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ সব সময়ই প্রস্তুত। বিশেষ করে মীর কাসেম আলীর রায়কে ঘিরে পুলিশের বাড়তি নজরদারি ছিল। এ কারণে তারা নাশকতা করতে পারেনি।’