গাজাভিত্তিক ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে নজিরবিহীন হামলা চালায়। তারা বিপুলসংখ্যক ইসরাইলি সৈন্যকে হত্যা করে, অনেক লোককে বন্দী করে। এর পর থেকে গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। তাদের হামলায় ২৩ হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছে।
হামাসের ওই হামলার বিষয়টি সবচেয়ে দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে পরিচিত মোশাদ বিন্দুমাত্র টের পায়নি। কিভাবে মোশাদকে জানতে না দিয়ে এমন অভিযান নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করতে পারল হামাস? এই প্রশ্নের জবাব এখনো খুঁজছে ইসরাইলসহ অন্যরা।
এ নিয়ে আশারক আল-আসওয়াতের বরাত দিয়ে জেরুসালেম পোস্ট একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে যে ৭ অক্টোবরের অভিযানের খবর হামাসের মাত্র পাঁচ নেতা জানতেন।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, হামাসের সশস্ত্র শাখা আল-কাসসাম ব্রিগেডের শীর্ষ পর্যায়ের একটি সূত্রের কাছ থেকে তারা তথ্য পেয়েছে। এতে বলা হয়, ওই অভিযানের খবর জানতেন মাত্র পাঁচজন : গাজায় হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার, আল-কাসসাম ব্রিগেডের নেতা মোহাম্মদ দেইফ, ইয়াহিয়ার ভাই মোহাম্মদ সিনওয়ার, সিনওয়ারের ঘনিষ্ঠ হামাস নেতা রুহি মোস্তফা, দেইফের ঘনিষ্ঠ এবং আল-কাসসাম ব্রিগেডের গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধান আয়মান নোফাল। আয়মান ১৭ আগস্ট ইসরাইলি হামলায় নিহত হন।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া, হামাসের উপ-নেতা সালেহ আল-আরোরি (সম্প্রতি ইসরাইলি হামলায় নিহত), হামাসের প্রভাবশালী নেতা মারওয়ান ইসা পর্যন্ত এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না।
ওই ঝটিকা হামলায় ১২ শ’র বেশি ইসরাইলি নিহত হয়। আর তারা প্রায় ২৪০ জনকে বন্দী করে গাজায় নিয়ে আসে। হামাস ২২টি গ্রামে হামলা চালায়, রেইমে অবস্থিত ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) দক্ষণাঞ্চলীয় ঘাঁটিও আক্রান্ত হয়।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আল-আকসা ফ্লাড অপারেশন’ নামে অভিহিত ওই অভিযানে হামাসের মাত্র ৭০ জন যোদ্ধা অংশ নেয়। তারা উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত পুরো গাজা সীমান্তে হামলাটি চালিয়েছিল।
ইসরাইলি এলাকায় ঢোকার জন্য তারা গাজা-ইসরাইল প্রাচীর গুঁড়িয়ে দিতে বিস্ফোরক ব্যবহার করে। পদাতিক যোদ্ধাদের পেছনে পেছনে মটরচালিত গ্লাইডার ও প্যারাস্যুট নিয়েও যোদ্ধারা নির্দিষ্ট স্থানে অবতরণ করে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই অভিযানের জন্য যাদের বাছাই করা হয়েছিল, তারা ছিলেন গাজার বিভিন্ন এলিট ইউনিটের সদস্য। কয়েক বছর ধরে তারা ব্যাপক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ঠিক কোন অভিযান তারা চালাবেন, তা না জেনেই তারা প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছিল।
প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর এসব এলিট সদস্যরা তাদের বিশেষ প্রস্তুতির বিষয়টি গোপন রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে তারা কখন অভিযানটি হবে, তা জানত না। এমনকি হামাসের অন্যান্য নেতার কাছ থেকেই বিষয়টি গোপন রাখা হয়। ইসরাইলি গোয়েন্দারা যাতে না জানে, সেজন্য চরম গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭ অক্টোবরের মাত্র তিন দিন আগে শীর্ষ পাঁচ নেতা আল-কাসসাম ব্রিগেডের ইউনিট নেতাদের আসন্ন মিশন সম্পর্কে আভাস দেন। কিন্তু তখনো কখন হামলা চালানো হবে, তা জানানো হয়নি।
এই পর্যায়ে হামলার সময় না জেনেই ফিল্ড কমান্ডাররা সতর্কভাবে তাদের নির্বাচিত বাহিনীর প্রস্তুতি শুরু করেন।
প্রায় একই সময় গাজার রকেট ইউনিটের নেতা আয়মান সিয়াম (ইসরাইলি হামলায় নিহত) একইসাথে কয়েক শ’ রকেট নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুতি নিতে অবগত হন। যুদ্ধের প্রথম চার ঘণ্টায় হামাস তিন হাজারের বেশি রকেট নিক্ষেপ করে তারা।
৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় পাঁচ সদস্যের দলটি অভিযানের জন্য ৭ তারিখ শনিবার সকালকে বেছে নেয়। ওই দিন ছিল ইহুদিদের সিমচ্যাত তোরাহ ছুটি। ফলে ইসরাইলি বাহিনী ছিল শিথিলভাবে।
ওই দিন রাতে হামাস নেতৃত্ব তাদের বাহিনীকে অবস্থান গ্রহণ করতে বলে। হামাসের ফিল্ড কমান্ডাররা এবং এলিট বাহিনী নির্দেশনা লাভ করে। তারা খুব ভোরে হামলা চালানোর চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু করে দেয়।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, হামাসের অন্য নেতারা হামলা শুরুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে বিষয়টি জানতে পারেন। তাদেরকে আত্মগোপনে চলে যেতে বলা হয়। কারণ ইসরাইলি বাহিনী হামলা চালাতে পারে। এই সময়েই হানিয়া ও আরোরিকে আরো বিস্তারিত তথ্য দেয়া হয়।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, হামাসের মূল পরিকল্পনা ছিল, তারা যত বেশি সম্ভব ইসরাইলি সৈন্যকে আটক করবে। তারপর সম্ভব হলে কয়েকটি গ্রামে যাবে।
কিন্তু হামলার মুখে ইসরাইলি বাহিনী দ্রুত গুঁড়িয়ে গেলে হামাস যোদ্ধারা বিস্মিত হয়ে পড়ে। হামলার ৯০ মিনিট পরে আরো গ্রামে হামলার লক্ষ্যে আরো যোদ্ধা পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হয়।
এই পর্যায়ে অনেক কম প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদেরও ইসরাইলে পাঠানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, হামাসের অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল যত বেশি সংখ্যক ইসরাইলিকে অপহরণ করা। ওই লক্ষ্য হাসিলের জন্য বাকি হামলাগুলো ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।