খালি পড়ে আছে ৪ বছর ধরে ৫ কোটিরও বেশি টাকা খরচ করে নির্মিত চকবাজার কাঁচাবাজার । রাস্তা এবং ফুটপাত দখল করে চলছে কাঁচাবাজার। যানজট এবং জনভোগান্তি চরমে পৌঁছালেও অবৈধ বাজার উচ্ছেদ কিংবা নয়া মার্কেট চালুর কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। বহুদিন ধরে স্থানীয় বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে বাজারটি রাস্তা থেকে সরিয়ে নেয়ার দাবি থাকলেও বরাবরই তা উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। অভিযোগ রয়েছে, রাস্তা এবং ফুটপাত দখল করে চলা অবৈধ বাজার থেকে হাসিল, থানা পুলিশ এবং ফাঁড়ির নামে প্রতি মাসে তোলা হচ্ছে কোটি টাকারও বেশি। দীর্ঘদিন ধরে চকবাজার কাঁচাবাজার ঘিরে এক অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সরেজমিনে পরিদর্শন এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পরিচালিত চকবাজার কাঁচাবাজার শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বাজার। সন্নিহিত ঘনবসতিপূর্ণ বিস্তৃত এলাকার শত শত মানুষ এই বাজার থেকে প্রাত্যহিক বাজার সদাই করেন। দীর্ঘদিনের পুরনো বাজারটি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পুনর্নির্মাণ করে। সাত তলা ভবন নির্মাণের একটি প্রকল্প সিটি কর্পোরেশন গ্রহণ করে। এতে ৫ কোটি ৯৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা খরচ করে তিন তলা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়। প্রতি ফ্লোরে ৭৬টি দোকান রয়েছে। ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর বাজারটি উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের পর নিচতলার মাছবাজার চালু করা হলেও দোতলা এবং তিন তলার দোকানগুলো আর চালু হয়নি। গত ৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাজারটি অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে। বাজারের দোতলা এবং তিনতলায় মশারি খাটিয়ে মানুষ ঘুমায়, কুকুরেরও বসতি গড়ে উঠেছে পাকা ভবনটিতে। গতকাল সকালে বাজার চলাকালে চারদিকের রাস্তা এবং ফুটপাত জুড়ে যখন মানুষ গম গম করছে তখন ভবনটির দোতলায় মশারি খাটিয়ে বহু মানুষকে ঘুমাতে দেখা গেছে।
সরেজমিন পরিদর্শনকালে কাঁচাবাজারের সাইনবোর্ডের পাশাপাশি স্থানীয় কাউন্সিলর নুর মোস্তফা টিনুর ছবিসহ সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। কাউন্সিলর এখানে অফিস করেন। কাউন্সিলর অফিসে ঢোকার পথেও বড়সড় সবজির দোকান স্থাপিত হয়েছে। দু’পাশে বিক্রি হচ্ছে মুরগি ও সবজি। ভেতরের দিকে পান ও চা–সিগারেটের দোকানও জমজমাটভাবে চলছে। বাজার ঘিরে থাকা রাস্তা এবং ফুটপাত জুড়ে কাঁচাবাজারে লোকজনের ভিড় থাকলেও ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা খাঁ খাঁ করছে। গতকাল বাজারটির মূল ডিজাইনে না থাকলেও নতুন করে নির্মাণ কাজ চালাতে দেখা গেছে।
স্থানীয়রা জানান, খালি পড়ে থাকা বাজারের দ্বিতীয় তলায় টিসিবির পণ্য বিতরণ কাজে ব্যবহার করেন কাউন্সিলর। এছাড়া শুক্রবার দুপুরে গরিব ও অসহায় মানুষকে ভাত খাওয়ানোর কার্যক্রমও চলে। সোমবারে বিক্রি হয় গরু মহিষের মাংস। সপ্তাহের অন্য দিনগুলো খালি থাকে ভবনটি।
চকবাজার কাঁচাবাজার চালু না হলেও বাজারটিকে ঘিরে প্রায় দেড় কিলোমিটার সড়ক জুড়ে শত শত দোকান গড়ে উঠেছে। রাস্তা এবং ফুটপাত দখল করে গড়ে ওঠা এসব বাজারে সবজিসহ নানা ধরনের পণ্যের বেচাকেনা চলে। কাউন্সিলর অফিস ও চকবাজার থানার সামনের রাস্তায়ও বসে বাজার। দিনের শুরু থেকে বিভিন্ন পণ্যের ভাসমান দোকানের পাশাপাশি সন্ধ্যার পরে এটি মাছ বাজারে পরিণত হয়।
চকবাজার থেকে ধোনিরপুল হয়ে ফুলতলা পর্যন্ত শত শত দোকান। যার সবগুলোই ফুটপাত এবং রাস্তা দখল করে বসে। চকবাজার এবং সন্নিহিত এলাকায় গড়ে ওঠা দোকানগুলো থেকে প্রতিদিন হাসিলের নামে আদায় করা হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। এছাড়া চকবাজার থানা, টহল পুলিশ ও ফাঁড়ির নামেও নিয়মিত অর্থ প্রদান করে দোকান চালাতে হয় বলে গতকাল একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, নির্দিষ্ট হারে অর্থ প্রদান করতে হয়। এসব নিয়ে দরাদরি করা যায় না। প্রতিদিনই প্রতিদিনের টাকা পরিশোধ করতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ে লোক এসে এসব টাকা তুলে নিয়ে যায়। একজন ক্ষুদে দোকানিকে গড়ে দুইশ টাকারও বেশি অর্থ এসব চাঁদাবাজদের হাতে তুলে দিতে হয়। মাসে এই টাকার পরিমাণ কোটি টাকারও বেশি বলেও স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল কয়েকজন ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা বৈধ কাঁচাবাজারে গিয়ে ব্যবসা করতে চাই। কিন্তু সেখানে সুযোগ না থাকায় রাস্তার উপরে বসতে হয়। স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, কাঁচাবাজারকে ঘিরে ফুটপাত জুড়ে যে নৈরাজ্য তাতে রাস্তাটি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। ইচ্ছে করলেও স্বচ্ছন্দে এই রাস্তায় চলাচল করা যায় না। সকালে থেকে রাত অব্দি যানজটে স্থবির হয়ে থাকে। মানুষের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছালেও কারো কোনো মাথাব্যথা নেই।
স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্র চকবাজার কাঁচাবাজার এবং অবৈধ বাজার পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণে জড়িত। এরাই মূলত কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি করে ভাগবাটোয়ারা করে থাকে। এই চক্রের সঙ্গে জাহাঙ্গীর আলম, মোহাম্মদ নুরুন নবী, আজাদ, রাসেল, সোহেল, আলী, ল্যাডা নাছির, হারুন, আনিছ, রুবেল, মানিক, নাহিদ, অভিকসহ বেশ কয়েকজন জড়িত। হাসিল উত্তোলনকারী রুবেল ও অভিকের নামে চকবাজার ও পাঁচলাইশ থানায় একাধিক মামলা রয়েছে বলেও স্থানীয়রা জানিয়েছেন। থানা পুলিশের একজন ক্যাশিয়ার চাঁদাবাজির ব্যাপারটি মনিটরিং করে বলেও ব্যবসায়ীরা জানান। ফুটপাত এবং রাস্তা দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ দোকানগুলোর কোটি কোটি টাকার চাঁদা বিভিন্ন প্রভাবশালী মানুষের কাছেও পৌঁছে বলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বিষয়টি নিয়ে চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওয়ালিউদ্দিন আকবর জানান, আমি মাত্র কয়েকদিন আগে এই থানায় যোগ দিয়েছি। বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানি না। তবে কোনো অনিয়ম থাকলে তা অবশ্যই রোধ করা হবে। তিনি ব্যাপারটির খোঁজ খবর নেবেন বলেও জানিয়েছেন।
চকবাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুর মোস্তফা টিনু দৈনিক আজাদীকে বলেন, এত সুন্দর ভবন ফেলে রেখে বাজার বসছে ফুটপাতে। এতে যানজট হচ্ছে, বদনাম হচ্ছে ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে আমারও। তাই আমিও চাই না ফুটপাতে বাজার বসুক। নতুন ভবনে বাজারটি পুরোদমে চালু করার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে মেয়র মহোদয়কেও জানিয়েছি। কয়েকবার মাইকিং করেও ব্যবসায়ীদেরও নতুন ভবনে চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছি। কিন্তু এখানে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় ক্রেতা আসে না, তাই ব্যবসায়ীরাও সেখানে যাচ্ছে না। এখন আমরা পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি। আশা করছি খুব শীঘ্রই এর সমাধান হবে।