এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে আওয়ামী লীগ আসন্ন নির্বাচন যাতে একপেশে, আকর্ষণহীন না হয় এবং ভোটার স্বল্পতার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা সংকটে না পড়ে এ জন্য দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত নেতাদের । নেতাকর্মীরা নৌকার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ না নিয়ে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করলেও তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না বলে জানান দেওয়া হয়েছে। এতে সারা দেশের দুই শতাধিক আসনে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা হয়ে উঠছে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিভক্তি ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
পুলিশ প্রশাসন, একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয় সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, বরাদ্দকৃত প্রতীক নিয়ে ১৭ ডিসেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরুর পর মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় সারা দেশে বহু সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। যার ৮০ শতাংশই নৌকা এবং আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছে। এতে প্রচারণার উৎসব আনন্দ অনেকটাই ফিঁকে হয়ে পড়েছে। দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম অস্বস্তি। অনেকের আশঙ্কা, নির্বাচনের দিনক্ষণ যত ঘনিয়ে আসবে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল আরও ভয়ংকর রূপ নেবে। নিজেদের মধ্যকার সংঘাত-সহিংসতায় ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে। আর এ ধরনের ঘটনা চলমান থাকলে ভোটার উপস্থিতি উদ্বেগজনক হারে কমবে। এ অবস্থায় খোদ আওয়ামী লীগের সক্রিয় নেতাকর্মী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনরা ভোটবিমুখ হয়ে ওঠার শঙ্কা রয়েছে।
আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের একাধিক নেতা এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, প্রচার-প্রচারণার উৎসব শুরু হতেই দলীয় নেতাকর্মীরা যেভাবে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে, তাতে ভোটের আগে এ পরিস্থিতি কোন জায়গায় গিয়ে ঠেকে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। অভ্যন্তরীণ সংঘাত চরমে পৌঁছলে এ পর্যায়ে দলীয় হাইকমান্ডের হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকবে কি না তা নিয়েও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বিএনপি নির্বাচনে না আসায় এমনিতেই ভোটার উপস্থিতি কম হবে। এছাড়া সরকারবিরোধী এ দলটি ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দিতে নানা ধরনের নাশকতামূলক ঘটনা ঘটাতে পারে- এমন আশঙ্কা রয়েছে। এর ওপর নৌকা ও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যকার সংঘাত-সহিংসতা ভয়ংকর রূপ নিলে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো দুষ্কর হয়ে পড়বে।
ঢাকা-৫ আসনের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা পড়ছি মহাবিপাকে। এখান থেকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে হেভিওয়েট নেতা হারুনুর রশিদ মুন্নাকে। একই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লার ছেলে মশিউর রহমান মোল্লা। দলের আরেক ডাকসাইটে নেতা কামরুল হাসানও ঢাকা-৫ থেকে লড়ছেন। ফলে স্থানীয় নেতাকর্মীরা চরম দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছেন। তারা কাকে বাদ দিয়ে কার পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় নামবেন তা নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগছেন। এক নেতার পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিলে পাছে অন্যরা মনে কষ্ট পান এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে বিরাগভাজন হয়ে পড়েন এ আশঙ্কায় অনেকে ভোটের মাঠ থেকে দূরে রয়েছেন।’
একই এলাকার একটি স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক জানান, বিগত সময় জাতীয় নির্বাচনে এ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) ইউনিটের নেতারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করেছেন। তবে এবার তারা কার পক্ষ নিবেন তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন। কেননা নির্বাচনে যিনি জিতবেন, তিনিই হাসপাতালের ম্যানেজিং কমিটির মেম্বার নিযুক্ত হবেন। তাই তারা কারো পক্ষে প্রচারণায় নেমে দলীয় কোনো নেতার রোষানলে পড়তে চান না।
এদিকে ঢাকা-১৯ আসনের একাধিক নেতাকর্মী ও সমর্থকও একই ধরনের বিপত্তির কথা জানান। তাদের ভাষ্য, সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. এনামুর রহমানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন হেভিওয়েট প্রার্থী তৌহিদ জং মুরাদ। দু’জনই আওয়ামী লীগের নিবেদিত নেতা। দলীয় নেতাকর্মীরা তাদের নেতৃত্বেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। বিরোধী দলকে রাজপথে প্রতিহত করেছেন। তারাই এখন প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠায় সাধারণ নেতাকর্মীরা কার পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় নামবেন সে ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। দল সমর্থিত ভোটাররাও এ নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছেন।
জানা গেছে, এবার নির্বাচনে প্রায় ১ হাজার ৯০০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন অধিকাংশই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত নেতারা। কৌশলগত কারণে আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্রদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বরং তাদেরকে স্বাগত জানিয়েছে। এমনকি দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার আগেই মনোনয়ন প্রত্যাশীদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, কেউ বিনা ভোটে (প্রতিদ্বন্দ্বিতায়) নির্বাচিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একইসঙ্গে দলীয় ডামি প্রার্থী রাখার নির্দেশনা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের চাপ প্রয়োগ না করতে দলের প্রার্থীদের নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। আর এতেই দলটির মনোনয়ন বঞ্চিতদের মধ্যে অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন।
এদিকে নির্বাচনের মাঠে একই দলের একাধিক প্রার্থীর উপস্থিতি বিশৃঙ্খলা এবং দলীয় কোন্দল ভয়ংকরভাবে বাড়াতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও। রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরিন বলেন, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখানোর জন্য নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোট করার সুযোগ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তারা আসলে দলটির ছায়াপ্রার্থী। আপাতদৃষ্টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিরীহ মনে হলেও ভোটের মাঠের চিত্র ভিন্ন রকম হতে পারে। এতে তৃণমূলে দলের কোন্দল আরও বাড়বে এবং সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
তবে একই আসনে নৌকার সঙ্গে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভোটের লড়াইয়ের গণ্ডি পেরিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাত-সহিংসতার দিকে যেতে পারে এ আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তা এরইমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। প্রতীক বরাদ্দের পরপরই প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর ও হুমকি-ধামকির ঘটনায় দেশের শতাধিক আসন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
মঙ্গলবার টাঙ্গাইল-২ (ভুয়াপুর-গোপালপুর) আসনে ভুঞাপুরে স্বতন্ত্র প্রার্থী ইউনুস ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু ও তার গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় নৌকার প্রার্থী তানভীর হাসান ছোট মনিরের সমর্থকদের দায়ী করে থানা, নির্বাচন কমিশন ও রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ইউনুস।
একই দিন টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনেও স্বতন্ত্র প্রার্থী সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন নৌকা সমর্থকদের দ্বারা তার দু’টি নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর ও সমর্থকদের ওপর হামলা ও আহতের ঘটনায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
এর আগে গত সোমবার রাতে ঘাটাইলে (টাঙ্গাইল-৩) স্বতন্ত্র প্রার্থী আমানুর রহমান খান রানার দু’টি নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর ও সমর্থকদের মারধরের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় রানা নৌকার প্রার্থী ডা. কামরুল হাসানের সমর্থকদের দায়ী করেন।
নেত্রকোনা-৩ (আটপাড়া-কেন্দুয়া) আসনে নৌকার প্রার্থী অসীম কুমার উকিলের সমর্থকদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী ইফতিকার উদ্দিন তালুকদার পিন্টুর কেন্দুয়া উপজেলার মাসকা বাজারে নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলার অভিযোগ উঠেছে। এতে ১২ জনের বেশি আহত হন। এ সময় সেখানে থাকা ১৩-১৪টি মোটর সাইকেল ভাঙচুর করা হয়।
মঙ্গলবার যশোর-১ (শার্শা) আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ও তার সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ আফিল উদ্দিনের সমর্থকরা তাদের ১১ জনকে পিটিয়ে জখম করে বলে অভিযোগ করেন আশরাফুল আলম। জয়পুরহাট-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাহফুজ চৌধুরীর সহযোগীদের ওপর হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের সমর্থকদেন বিরুদ্ধে। তার প্রধান এজেন্ট ও মাত্রাই ইউপি চেয়ারম্যান শওকত হাবীব তালুকদারকে হত্যার চেষ্টা করা হয় এবং তার নির্বাচনী কার্যালয়ে ঢুকে ভাঙচুর এবং ১২ হাজার পোস্টার লুট করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ফরিদপুরে এ কে আজাদের প্রচারে বাধা; প্রচারপত্র ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকদের বিরুদ্ধে। জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহবুবুর রহমান এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রশিদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে উভয় পক্ষের চারজন আহত হন।
ঢাকা-১৯ (সাভার-আশুলিয়া) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী তালুকদার মো. তৌহিদ জং ওরফে মুরাদ এবং আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের অস্থায়ী নির্বাচনী কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এনামুর রহমানের নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
নাটোর-৪ (গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আসিফ আবদুল্লাহ বিন কুদ্দুসের দুই সমর্থককে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, সাধারণত দেখা যায়, নির্বাচনে যে বিরোধ তৈরি হয় সেই বিরোধ যুগ যুগ ধরে চলে, এটি সহজে মিটে না। যেসব আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দাঁড়িয়েছেন এবং আওয়ামী লীগের কর্মীদের একটি অংশ তাদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন, ওইসব জায়গায় কার্যত আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই দ্বিধাবিভক্তি পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের জন্য বড় সংকটের কারণ হবে।
এ প্রসঙ্গে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘ঐহিত্যবাহী সংগঠন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সব সময়ই দলীয় শৃঙ্খলা মেনে চলেন, চেইন অব কমান্ড ফলো করেন। যদিও এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তারপরও নেতাকর্মীরা আমাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জিতল, নাকি স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতল, সেটা বড় বিষয় নয়। জনগণ যা রায় দিবে, সবাই তা মেনে নিবে। নির্বাচনের পর নেতাকর্মীরা সব এক হয়ে যাবে।’