অবারিত খোলা চত্বর নেই। এই শহরে প্রকৃত কোনো পার্ক নেই। ডিসি হিল ও সিআরবি ছাড়া কংক্রিটের এই নগরীতে আর এক চিলতে খোলা চত্বরে সামান্য সবুজ ঘাস ছিল ষোলশহর ২ নং গেটের কাছে বিপ্লব উদ্যানে। এখন সেটুকুও থাকবে না। এই নগরীর অভিভাবক চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নিজেই সে সবুজটুকু মুছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে হাতুড়ি–শাবল নিয়ে ভাঙনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে তারা।
তবে এমন পরিবেশবিধ্বংসী কাজ সিটি করপোরেশনের এবারই নতুন নয়। এই উদ্যানের সবুজ ধ্বংসের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৮ সালে। ওই বছর স্টাইল লিভিং আর্কিটেক্টস লিমিটেড ও রিফর্ম লিমিটেড নামে বেসরকারি দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে চসিক। সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ২০ বছরের জন্য সেখানে ২০টি খাবারের দোকান করা হয়। বিষয়টি নিয়ে তখনও আপত্তি তোলে নগরবাসী। তাতে তো কর্ণপাত করা হয়ইনি বরং উল্টো গত ২২ আগস্ট নতুন করে আরেকটি চুক্তি করে চসিক। চুক্তি অনুযায়ী রিফর্ম কনসোর্টিয়াম কয়েকদিন আগে কাজও শুরু করেছে।
বর্তমানে সেখানে কংক্রিটের অবকাঠামো আছে ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ। দোকানসহ তার পরিমাণ ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ। সবুজ আছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। সবুজ অংশের ভিতর রয়েছে কিছু বড় গাছ এবং কিছু আর্টিফিসিয়াল গাছ ও ঘাস। এখন নতুন চুক্তি অনুযায়ী, উদ্যানের পূর্ব পাশে দোতলায় ২০০ ফুট দীর্ঘ স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। সেখানে হবে কফিশপ। তার একটি অংশে দোতলায় চট্টগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসসংবলিত জাদুঘরসহ প্রদর্শনী কেন্দ্র থাকবে। ওইটুকু জায়গাতে কেন মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর করা হবে সেটিও বোধগম্য নয়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কি এতই ক্ষুদ্র ও হালকা একটি ব্যাপার যে, একটি পার্কের ভেতর কয়েক শ বর্গফুটের জায়গায় তা করতে হবে? এই শহরে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করার জন্য কি সুপরিসর কোনো জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না? নাকি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আড়ালে বাণিজ্যিক লক্ষ্য হাসিল করাই প্রধান উদ্দেশ্য?
এছাড়া পূর্ব পাশে জাতীয় পতাকার আদলে স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম দ্বারা তৈরি একটি কাঠামো হবে। ওই কাঠামোর নিচে কিডস বা গেমিং জোন করা হবে। কাঠামোটা হেলানো অবস্থায় করা হবে। তাই পূর্ব পাশে বিদ্যমান খালি জায়গা কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। একইসঙ্গে কাঠামোর ওপর, নিচ ও দুই পাশে পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানের লোগো প্রদর্শন করা হবে। উদ্যানে ১ হাজার ৩০০ বর্গফুটের দুটি স্টিলের কাঠামোর ভেতর গেমিং জোন করা হবে। ২৫টি ডিজিটাল স্ক্রিন, বিলবোর্ড বা মেগা সাইন স্থাপন করার সুযোগ আছে চুক্তি অনুযায়ী। এমনকি ডিজিটাল স্ক্রিন, মেগাসাইন, এটিএম বুথ, কিয়স্ক, প্রদর্শনী কেন্দ্র, কিডস এক্সপেরিয়েন্স বা গেমিং জোন স্থাপন করারও সুযোগ আছে চুক্তিতে।
এতকিছুর পর বিপ্লব উদ্যানে আর খোলা জায়গা থাকবে কীভাবে? আমরা বুঝতে পারি না আমাদের নীতিনির্ধারক ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা উন্নয়ন বলতে শুধু ইট–সিমেন্ট–কংক্রিটের কাঠামো বোঝেন কেন? একটি শহরে বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগই কি থাকবে না?
নগরে কোনো অবকাঠামো করতে হলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে সেটাও মানছে না চসিক। পরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলার দায়িত্ব যে সংস্থার, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, তার প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ নিজেই বলেছেন, একটি শহরে ন্যূনতম ৪০ শতাংশ উন্মুক্ত জায়গা থাকা প্রয়োজন। আমাদের ১০ থেকে ২০ শতাংশও নেই। চট্টগ্রাম শহরে আগে থেকে যেসব উন্মুক্ত জায়গা ছিল সেগুলোও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। বিশ্বের দশটি ক্রমবর্ধমান নগরের মধ্যে চট্টগ্রাম একটি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এর বিকাশটি পরিকল্পনা মাফিক হয়নি। এখনও হচ্ছে না। যাদের ওপর নগর রক্ষার ভার তারাই নগরের ভক্ষক হয়ে উঠছেন। তাঁদের কাছে নগর, নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ বড় হয়ে ওঠে। ২০১৮ সালের চুক্তির ফলে সিটি করপোরেশন কতটুকু লাভবান হয়েছে এবং এবার কতটুকু লাভবান হবে সে তথ্য উপস্থাপন করা গেলে প্রকৃত উদ্দেশ্যটি জানা যেত।
এই নগরীকে রক্ষা করতে হলে সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর বাণিজ্যিক প্রবণতা ও হটকারিতার বিরুদ্ধে নাগরিকদের প্রতিবাদ করতে হবে এবং সংস্থা ও সংস্থার শীর্ষস্থানীয়দের জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে।