আজ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর ১১ তম মৃত্যুবার্ষিকী । এ উপলক্ষে মরহুমের পরিবার, আনোয়ারা উপজেলা পরিষদ, উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠন, আনোয়ারা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিকলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা ও সামাজিক সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। মৃত্যুবার্ষিকীর কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে – খতমে কোরআন, দোয়া মাহফিল, বিশেষ মোনাজাত, কবর জেয়ারত, পুষ্পমাল্য অর্পণ। এদিকে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে স্মরণসভা আজ শনিবার বেলা আড়াইটায় নগরীর জিইসি কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হবে। স্মরণসভায় প্রধান অতিথি থাকবেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম–সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। বিশেষ অতিথি থাকবেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক ওয়াসিকা আয়শা খান এমপি, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আনোয়ারার হাইলধরে মরহুমের গ্রামের বাড়িতে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর কবর জেয়ারত করবেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদসহ ও পরিবারের সদস্যরা।
উল্লেখ্য, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, রাজনীতিক, শিল্পোদ্যোক্তা, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। জীবনের নানা ক্ষেত্রে সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ছিলেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছাড়াও জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন চারবার। নবম জাতীয় সংসদে তিনি ছিলেন পাট বস্ত্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি।
১৯৪৫ সালে আনোয়ারা হাইলধর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তাঁর পিতার নাম নুরুজ্জামান চৌধুরী। তিনি আইনজীবী ছিলেন। তাঁর মাতার নাম খোরশেদা বেগম। তিনি বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিল্পপতি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার মরহুম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দ্বিতীয় কন্যা নুর নাহান জামানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে পটিয়া হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন ঐ বছরই ঢাকা নটরডেম কলেজে ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে পড়ার সময় তিনি বৃত্তি পেয়ে আমেরিকার ইলিনয় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হন। পরে তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশনে পড়াশোনা করেন। ওখান থেকে এসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফিরেন। তিনি ১৯৬৫ সালে ব্যবসা শুরু করেন। রাজনৈতিক জীবনে ১৯৫৮ সালে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন বাবু। ১৯৬৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তার পাথরঘাটাস্থ জুপিটার হাউজ থেকে মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হত। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামের আসার পর জুপিটার হাউস থেকে সাইক্লোস্টাইল করে প্রচার করা হয়। তার বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সব জায়গায় পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আখতারুজ্জামান বাবু ভারতে যান এবং সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। তিনি প্রথম লন্ডনে যান। সেখান থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে আমেরিকায় যান। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) নির্বাচিত হন, আখতারুজ্জামান বাবু ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন। তিনি ’৭২ সালের সংবিধানের অন্যতম স্বাক্ষরকারী। স্বাধীনতার পর ১৯৮৬, ১৯৯১ এবং ২০০৯ সালে তিনি আনোয়ারা–কর্ণফুলী আসনে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর আখতারুজ্জামান বাবু দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আখতারুজ্জামান বাবু নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন এবং পরবর্তীতে দলের পুনরুজ্জীবন ও পুনর্গঠনে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি কারা নির্যাতন ভোগ করেন।
কেবল রাজনীতিতেই নয়, আখতারুজ্জামান বাবু একজন সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা ছিলেন। স্বাধীনতার পূর্বে তিনি বাটালি রোডে রয়েল ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে তিনি আসিফ স্টিল মিল, জাবেদ স্টিল মিল, আসিফ সিনথেটিক, প্যান আম বনস্পতি, আফরোজা অয়েল মিল, বেঙ্গল সিনথেটিক প্রোডাক্ট ইত্যাদি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। ভ্যানগার্ড স্টিল মিল, সিনথেটিক রেজিন প্রোডাক্ট ক্রয় করে স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশের প্রথম দু’দশকে জামান শিল্পগোষ্ঠীর গোড়াপত্তন করেন। তিনি বিদেশি মালিকানাধীন আরামিট শিল্প কারখানা ক্রয় করে সেটিকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। বাংলাদেশ বেসরকারি ব্যাংকিং সেক্টর প্রতিষ্ঠায় তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তিনি দেশে দ্বিতীয় প্রাইভেট ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল) এর উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি দুই দফায় চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৮৮ সালে তিনি দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওআইসিভুক্ত দেশসমূহের চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ৭৭ জাতি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি যিনি এই মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ব্যক্তি জীবনে তিনি তিন পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর বড় ছেলে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি বর্তমানে আনোয়ারা–কর্ণফুলী আসনের সংসদ সদস্য ও ভূমিমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন। মেজ ছেলে আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল বাংকের (ইউসিবি) ইসি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর ছোট ছেলে আসিফুজ্জামান চৌধুরী জিমিও একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আখতারুজ্জামান বাবুর ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে কবর জেয়ারত, পুষ্পমাল্য অর্পণ, খতমে কোরআন, মিলাদ মাহফিল ও বিশেষ মোনাজাতের মধ্য দিয়ে দিনব্যাপী কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।
আনোয়ারা উপজেলা চেয়ারম্যান তৌহিদুল হক চৌধুরী বলেন, আনোয়ারা উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে খতমে কোরআন, দোয়া মাহফিল ও পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হবে।
চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ–সভাপতি এসএম আলমগীর চৌধুরী জানান, জেলা পরিষদের উদ্যোগ বর্ষীয়ান রাজনীতিবীদ বাবুর ১১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে কোরআনখানি, মিলাদ মাহফিলসহ নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। ২০১২ সালের এদিনে বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক সিঙ্গাপুরের চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।