আমাদের সাথে পরিচয়ও ছিল না। ২৭ বছর বাবা সাথে ছিল না। দীর্ঘ বছর নিখোঁজ থাকার পর হঠাৎ এলাকায় এসে চাচাদের সাথে একত্রিত হয়ে আমাদেরকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করে। এতে আমরা বাধা দিই। এজন্য বাবা মার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে বিভিন্ন ধরনের কুফরি কালাম/তাবিজ করে তার ক্ষতি করে। অসুস্থ হয়ে পড়ে মা। পরে আমরা জানতে পারি, বাবার আরো একটি সংসার আছে। আমি ছোটবেলা থেকে বাবাকে দেখিনি। এক–দেড় বছর আগে প্রথম দেখি। জায়গাজমি নিয়ে ঝামেলার কারণে চাচারা আমার বড় ভাইকে মারধর করে। যার কারণে ভাইয়ের মাথায় সমস্যা দেখা দেয় এবং সে বাবার উপর বেশি ক্ষিপ্ত হয়।
পতেঙ্গায় নৃশংসভাবে খুনের শিকার বাঁশখালীর হাসান আলীর ছেলে শফিকুর রহমানকে রিমান্ড শেষে হাজির করা হলে গতকাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাদ্দাম হোসেনের আদালতে জবানবন্দি দেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি এসব কথা বলেন। জবানবন্দির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) আরফাতুল ইসলাম। জবানবন্দিতে শফিকুর বলেন, ঘটনার মাসখানেক আগে আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এজন্য মাকে বাঁশখালী থেকে ইপিজেডের বাসায় নিয়ে আসি। তাকে আনার মাসখানেক আগে বাবা বাঁশাখালীতে যায়। রোজার ঈদে বাবাকে ফোন করলে বলে, আমার কোনো সন্তান নাই। তোর আম্মাকেও চিনি না। সেজন্য আমি বাবার ওপর ক্ষিপ্ত ছিলাম। পরে বাবা গ্রামের বাড়ি এলে তাকে ঘরে ঢুকতে নিষেধ করি এবং আম্মাকেও বলি যেন ঘরে ঢুকতে না দেয়। তখন আমি বিষয়টি স্থানীয় মেম্বার ছৈয়দ আহম্মদকে জানাই। তিনি আমাদেরকে ডেকে মিলমিশ করিয়ে দেন।
এর ২/৩ দিন পর কাউকে কিছু না বলে বাবা আবার চলে যায়। মোবাইল বন্ধ করে দেয়। বাবা আসার পরে কুফরি কালাম করলে আম্মা অসুস্থ হয়। এর আগে আম্মা সুস্থ ছিল। ঘটনার মাসখানেক আগে আম্মাকে চট্টগ্রামে নিয়ে এসে চিকিৎসা করাই। তখন বাবা আমাকে ফোন দেয় এবং মায়ের সাথে দেখা করতে চায়। আমাকে অনেকবার ফোন দেওয়ার পর তাকে বাসায় আসতে বলি।
শফিকুর বলেন, ঘটনার আগের দিন রাতে আনুমানিক ১০/১১টার দিকে বাবা আকমল আলী পকেট গেট এসে আমাকে ফোন দেয়। আমি তাকে বাসায় নিয়ে আসি। বাবা আসার সময় ব্যাগে করে কিছু ফলমূল, একটি বডি স্প্রে ও কিছু তাবিজ নিয়ে আসে। বাবা আসার ঘণ্টাখানেক পর আমার ভাইও বাসায় আসে। ভাই রাতে এলেও বাবার সাথে দেখা হয়নি। রাতে বাবাকে বাসার সামনের একটি খালি রুমে থাকতে দিই। আমার ঘরে আম্মা, বউ ও ভাই ঘুমায়। আমি রুমের বাইরে ছিলাম।
সকালে বাবা, মা ও বউ একসাথে নাস্তা করে। দুপুরে খাওয়ার পর আমি ও ভাই বাবার রুমে গিয়ে বাবার সাথে কথা বলি। আমি বলি, তুমি যে মাকে কুফরি কালাম করেছ, মা সুস্থ না হলে আমি তোমাকে ছাড়ব না। তখন বাবা আম্মাকে বাঁশখালী নিয়ে যেতে চায় এবং বলে তোর আম্মা বেশিদিন বাঁচবে না। মরলে মরুক। তখন আমি ক্ষিপ্ত হয়ে গামছা দিয়ে আব্বার মুখ বেঁধে, রশি দিয়ে হাত–পা বেঁধে বস্তায় ঢোকাই। এরপর বাইরে চলে যাই। তখন বিকাল ৪/৫টা। সন্ধ্যা ৭/৮টার পর বাসায় এলে ভাই বাবার রুম থেকে বের হয়ে আমাকে বাইরে নিয়ে যায়। কাঁপতে কাঁপতে বলে, আমি আব্বাকে মেরে ফেলেছি। বাবার রুমে গিয়ে দেখি, বস্তার মুখ বাঁধা। তখন আমি রুমে গিয়ে আমার বউ আনারকলিকে ডাকি। তার সাথে লাশ গুম করার পরামর্শ করি। আমার ভাইকে বলি, লাশ ফেলে তারপর যেতে। একপর্যায়ে আমি ও কলি ঘটনার দিন রাত ১২টার পর লাশের বস্তা আমার ঘরে নিয়ে আসি। এর আগে বোন জামাইয়ের মাধ্যমে সিএনজি করে আম্মাকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিই। লাশ ঘরে আনার আগে ভাই লাশ কাটার জন্য একটি ধামা ও অনান্য জিনিসপত্র নিয়ে আসে। আমাকে ফোন দিলে আমি কলিকে সেগুলো আনতে পাঠাই। কলি সেগুলো আমার রুমে নিয়ে রেখে দেয়। পরে ভাই রুমে গিয়ে বস্তা থেকে লাশ বের করে বাথরুমে গিয়ে ১০ টুকরা করে। তখন আমি বাইরে পাহারায় ছিলাম। কলি পাশের রুমে আন্টির বাসায় ছিল। ওইদিন রাতে কলি আন্টির রুমে ঘুমায়। আমি ভাইকে বলি, আমার ঘরে সবকিছু আছে, যা লাগে তা ব্যবহার করে লাশটা গুম করতে।
ঘটনার দিন রাত অনুমান ২টার পরে ভাই আমাকে ফোন দিয়ে একটা লোক নিয়ে আসতে বলে। তখন আমি রাস্তা থেকে একটা টোকাইকে নিয়ে যাই। সে একটি বস্তা করে বাবার শরীরের অংশটি আকমল আলী খালে ফেলে দেয়। আমি তাকে ৫০০ টাকা দিই।
শফিকুর বলেন, পরের দিন সকালে ভাইকে ফোন দিয়ে ঘর থেকে লাশের বাকি অংশ বের করতে বলি। তখন আমার স্ত্রী ও ভাই একটি লাগেজে করে বাবার দেহের খণ্ডিত অংশ নিয়ে বাসা থেকে বের হই। আমি তাদেরকে একটি রিকশা নিয়ে সিমেন্ট ক্রসিং যেতে বলি। তারা সেখানে গেলে সিএনজি ভাড়া করি। সিএনজিতে করে আমরা ৩ জন ১৫ নং ঘাটের দিকে রওনা দিই। ১৫ নং ঘাটে যাওয়ার সময় ভাইকে ১২ নং ঘাটের সামনে লাগেজে থাকা বাবার লাশের খণ্ডিত অংশ নিয়ে নামিয়ে দিই। ভাই লাশের লাগেজটি ১২ নং ঘাটে ফেলে দিয়ে বাঁশখালীতে মাকে দেখতে চলে যায়। আমি ও আমার স্ত্রী ১৫ নং ঘাটে নামি। সেখান থেকে একটি সিএনজি নিয়ে আকমল আলী বেড়িবাঁধে নামি। পরে বাসায় গিয়ে স্কুলব্যাগে থাকা মাথার অংশটি ফেলার জন্য সিএনজিতে করে পতেঙ্গা বিচে আসি। বিচে এসে আমি ও কলি সাগরে নেমে ব্লকের ফাঁকে ব্যাগ থেকে মাথাটি নিয়ে ফেলে দিই। মাথার অংশটি কালো রঙের পলি দিয়ে মোড়ানো ছিল। মাথাটি ফেলার পর আমরা বাসায় চলে যাই। কলি ধামাটি তার পরিচিত একজনের বাসায় রাখে। ধামাটি অন্য কোথাও রেখে আসতে বলি।
ঘটনার ২ দিন পর পুলিশ আমাকে ফোন দিলে আমি ও কলি নোয়াখালী চলে যাই। সেখান থেকে ভোলা যাই। ভোলা থেকে কলিকে মহেশখালী পাঠিয়ে দেই। আমি ভোলা থেকে ঢাকা চলে যাই। এরপর ঢাকায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হই।
শফিকুর এক যুগ ধরে নগরীর ইপিজেড এলাকায় বসবাস করছিলেন। আগে গার্মেন্টসে চাকরি করলেও পরে মসজিদের জন্য টাকা তোলা ও মনু সওদাগরের সাথে জায়গাজমি কেনাবেচার কাজ করতেন।
গত ২১ সেপ্টেম্বর রাতে পতেঙ্গা ১২ নম্বর ঘাট সংলগ্ন বিমানবন্দর সড়কের পাশে ঝোপে একটি লাগেজের ভেতর থেকে হাত–পায়ের আটটি টুকরা উদ্ধারের পর পতেঙ্গা থানায় মামলা করে পুলিশ। আগুলের ছাপ সংগ্রহ করে লাশের টুকরাগুলো হাসানের বলে জানানো হয়। পরে হাসানের স্ত্রী, বড় ছেলে, ছোট ছেলে শফিকুরের স্ত্রী আনারকলি ও সর্বশেষ শফিকুরকে হেফাজতে নেওয়া হয়। হাসানের শরীরের বিভিন্ন অংশ পাওয়া গেলেও মাথা এখনো পাওয়া যায়নি।