মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের হিসাব–নিকাশ পাল্টে যাচ্ছে। আয়ের চেয়ে ঋণের কিস্তি বেশি হবে। কত বছর পর বন্দর কর্তৃপক্ষ মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে লাভের মুখ দেখবে সেই হিসাব নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। জাপানের আর্থিক সহায়তায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বন্দর প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গভীর সমুদ্রবন্দরের মালিক হলেও একইসাথে দীর্ঘমেয়াদী ঋণের জালেও আটকা পড়ছে। শুরুতে ঋণ নিয়ে বিশেষ আলোচনা না হলেও শেষ পর্যন্ত ঋণের দায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে নিতে হয়েছে। অবশ্য সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত চট্টগ্রাম বন্দরকে ঋণের কবল থেকে রক্ষা করতে পারে বলে মনে করছেন বন্দরের কর্মকর্তারা।

সূত্রে জানা যায়, মাতারবাড়িতে ১২শ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে জাপানের আর্থিক সহায়তায়। জাইকা এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারিগারি ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড–সিপিজিসিবিএল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করছে। ১২শ মেগাওয়াটের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতিদিন ১০ হাজার টন কয়লা পোড়ানো হবে। দুই মাসের প্রয়োজনীয় অন্তত ৬ লাখ টন কয়লা এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মজুদ রাখা হবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রয়োজনীয় জ্বালানির যোগান দিতে বিদেশ থেকে প্রতি মাসে অন্তত তিন লাখ টন কয়লা আমদানি করতে হবে। একেকটি জাহাজে ৬০ হাজার টন কয়লা পরিবহন করলেও মাসে অন্তত ৫টি মাদার ভ্যাসেল এখানে হ্যান্ডলিং করতে হবে।

মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং কয়লা আমদানির পথ তৈরি করতে ১৪.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি চ্যানেল তৈরি করতে হয়। ২৫০ মিটার প্রস্থের, ১৬ মিটার গভীর এই চ্যানেল ধরে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং বিপুল পরিমাণ কয়লাও আমদানি করা হয়। এই চ্যানেল তৈরি করার সময় জাইকার একটি প্রতিনিধিদল চট্টগ্রাম বন্দরে এসে মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর করা যায় বলে জানায়। তারা জানায়, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১৪.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার গভীর এবং ২৫০ মিটার প্রস্থ যে চ্যানেলটি তৈরি করা হয়েছে সেটিকে যদি ১০০ মিটার বেশি প্রস্থ করে ৩৫০ মিটার এবং গভীরতা ২ মিটার বাড়িয়ে ১৮ মিটার করা হয় তাহলে এটি গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

বন্দর কর্তৃপক্ষের তৎকালীন শীর্ষ কর্মকর্তারা গভীর সমুদ্রবন্দরের বিষয়টি নিয়ে অগ্রসর হলে নতুন করে পরিকল্পনা গ্রহণ এবং মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন নামে আলাদা একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকা ব্যয়ে মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের জন্য জাইকা ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা ঋণ সুবিধা প্রদান করে। এর বাইরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার এবং সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা গভীর সমুদ্রবন্দর উন্নয়নে খরচ হবে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। জাইকার এই ঋণ পরিশোধের জন্য দশ বছরের গ্রেস পিরিয়ড রয়েছে। এরপর ঋণ পরিশোধ করা হবে।

বন্দর কর্তৃপক্ষ চ্যানেল সম্প্রসারণ, গভীরতা বাড়ানো, ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ, জেটিসহ বিভিন্ন অবকাঠামো এবং ইকুইপমেন্ট কেনা খাতে উপরোক্ত ঋণ সুবিধা নিচ্ছে। কিন্তু এখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১৪.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ২৫০ মিটার প্রস্থ এবং ১৬ মিটার গভীর চ্যানেল তৈরি করতে যে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা জাইকা ঋণ প্রদান করেছিল, এখন সেগুলোও চট্টগ্রাম বন্দরকে পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। শুরুতে এই ঋণ সুবিধা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে দেওয়া হলেও এখন তা বন্দর কর্তৃপক্ষের উপর তুলে দেওয়ায় প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে। ইতোমধ্যে এই প্রকল্পের কাজ প্রায় ৮৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। আগামী জানুয়ারিতে কেন্দ্রটির ১টি ইউনিটে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। অপর ইউনিট উৎপাদনে যাবে জুলাই মাসে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চ্যানেল খননে জাইকার দেওয়া প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। আগামী বছর না হলেও পরের বছর থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হতে পারে বলে আভাস দিয়ে সূত্র বলেছে, ইতোমধ্যে এই ঋণ বন্দর কর্তৃপক্ষকে পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ মাতারবাড়ি বন্দর গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে চালু হওয়ার আগেই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে জাইকার ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। বছরে গড়ে ৫শ কোটির বেশি টাকা ঋণের কিস্তি হিসেবে পরিশোধ করতে হবে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, এটি চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য কঠিন কাজ হবে।

মাতারবাড়ি বন্দরে বর্তমানে শুধুমাত্র কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি এবং কয়লাবাহী কিছু জাহাজ ভিড়ছে। গত বছর ১১২টি জাহাজ হ্যান্ডলিং করে বন্দর কর্তৃপক্ষ আয় করেছিল ১০ কোটি টাকা। এই আয় দশ গুণ বাড়লেও ঋণের কিস্তির টাকা বন্দরের নিজস্ব তহবিল ভেঙে দিতে হবে।

বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে চট্টগ্রাম বন্দরের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, আসলে ব্যাপারটি বন্দরের জন্য অনেক কঠিন হবে। আমরা বিষয়টি দফায় দফায় জানানোর চেষ্টা করেছি। প্রধানমন্ত্রীর দফতর পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি জানেন অপর একজন কর্মকর্তা বলেছেন। এই সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার বাইরে বন্দরের নিজস্ব প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। মাতারবাড়ির আয় দিয়ে এত বড় অংকের ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিষয়টি নিয়ে বিশেষ ঘোষণা দিলে কেবল চট্টগ্রাম বন্দর এই বোঝা থেকে নিস্তার পেতে পারে না।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031