আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসটি গ্রাহক হয়রানি ও ভোগান্তির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছেঝিনাইদহ । অফিসের নিচে হেল্প ডেস্ক থেকে শুরু করে তিন তলায় সহকারী উপ-পরিচালকের অফিস পর্যন্ত ঘুষের টাকা দিতে হয়। টাকা না দিলে পদে পদে হয়রানি ও ভোগান্তি পোহাতে হয় পাসপোর্ট গ্রহীতাদের। সোমবার হয়রানি ও ঘুষের অভিযোগ পেয়ে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে র্যাব-৬ পাসপোর্ট অফিসে অভিযান চালায়। এ ঘটনায় আটক হয় ১১ দালাল। তবে ঘুষখোর কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী আটক হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঝিনাইদহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে এক বছর আগে ফাইল প্রতি ৮০০ টাকা করে ঘুষ আদায় করা হতো। বর্তমান সহকারী উপ-পরিচালক আব্দুল মোত্তালেব সরকার ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই যোগদানের পর থেকে নেয়া হচ্ছে ৯০০ টাকা করে। এ হিসেবে দিনে আনুমানিক দুই লাখ টাকা করে ঘুষ আদায় হচ্ছে। অফিসের আলপিন নাহার নামে এক মহিলা ঘুষের টাকা আদায় করেন বলে কথিত আছে। সর্বশেষ গতকাল রবিবার ঝিনাইদহ সোনালী ব্যাংকে পাসপোর্টের বিপরীতে ২১৯ জন টাকা জমা দেন। যার প্রতিটি ফাইল থেকে ৯০০ টাকা করে মোট এক লাখ ৯৭ হাজার ১০০ টাকা ঘুষ আদায় করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে বর্তমান সহকারী উপ-পরিচালকের সময় (১৪ জুলাই ২০১৬ পর্যন্ত) পাসপোর্টের জন্য ২০ হাজার ৯০১টি আবেদনপত্র জমা পড়ে। এর মধ্যে ২০ হাজার ৬৮৪টি পাসপোর্ট বিতরণ করা হয়। অফিসের একটি সূত্রে জানা গেছে, প্রতি সপ্তাহে ঘুষের টাকা ভাগাভাগি হয়। এর মধ্যে সহকারী উপ-পরিচালক পান ৬০% ও বাকি ৪০% টাকা সাধারণ স্টাফরা ভাগ করে নেন। কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিসে দায়িত্ব পালনকালে আব্দুল মোত্তালেব সরকার রহিঙ্গা শরণার্থীদের পাসপোর্ট দিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। এ নিয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সরকারের ওপর মহলকে জানানো হলে তাকে বদলি করা হয়। তবে তার খুঁটির জোর থাকায় কোনো শাস্তি হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
ঝিনাইদহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী উপ-পরিচালক আব্দুল মোত্তালেব সরকার অভিযোগ অস্বীকার করে ঢাকাটাইমসকে বলেন, কে কোথায় ঘুষ নেন তা আমার অজানা।
এদিকে অভিযোগ উঠেছে উপ-পরিচালক আব্দুল মোত্তালেব সরকারের ঘুষ আদায় ও যৌন হয়রানিকে কেন্দ্র করে গত বুধবার ঘটে গেছে তুলকালাম কাণ্ড। ওই দিন হয়রানি, উত্ত্যক্তসহ যৌন নিগ্রহের অভিযোগ তদন্ত করতে ঝিনাইদহে আসেন প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (সংস্থাপন) নাসরিন পারভিন নুপুর। তিনি ঢাকা ফিরে যাওয়ার পর থেকেই সহকারী উপ-পরিচালক আব্দুল মোত্তালেব অন্যত্র বদলি হচ্ছেন এমন খবর চাউর হয়ে পড়ে।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাধুহাটী এলাকার মাসুদ নামে এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, তিনি অনলাইনে ফরম পূরণ করে জমা দিতে গেলে নানা রকম ভুল ধরে ফাইল ফিরিয়ে দেন কাউন্টারে বসে থাকা অফিসের কর্মচারী গৌতম কুমার সাহা। পুলিশ রিপোর্ট ভালো আসার পরও মামলা ও বয়স নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে ফিরিয়ে দেয়া হয় মাসুদকে।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, পাঁচ দিন অফিসে ঘোরার পর দালালদের মাধ্যমে ঘুষ দিয়ে ফিংগারিং ও ছবি ওঠার ব্যবস্থা হয়।
কোটচাঁদপুরের ধোপাবিলা গ্রামের শিমুল হোসেন, শান্তি মিয়া, বিল্লাল হোসেন, সদর উপজেলার হাজরা গ্রামের বিপুল হোসেনও মোবাইলে তাদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়ার কথা স্বীকার করেন। তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট প্রতি ৯০০ টাকা করে ঘুষ নেয়া হয়েছে বলে জানায়। মহেশপুরের মানিকদিহি গ্রামের বকুল জানান, তার ভাগ্নেকে পাসপোর্ট করতে মোট পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।
২০১৬ সালের ৩১ মে তারিখে ঝিনাইদহ শহরের চাকলাপাড়ার কমল কুমারের কাছ থেকে ইমার্জেন্সি পাসপোর্ট করার নামে ২১ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নিয়ম হচ্ছে একদিনেই পাসপোর্ট গ্রহীতাদের সব কাজ সারতে হবে। কিন্তু ঝিনাইদহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে ঘুষের টাকা না দিলে দিনের পর দিন ঘুরিয়ে চরমভাবে হয়রানি করা হয়। অভিযোগ পাওয়া গেছে, ঝিনাইদহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে আউট সোর্সিং ও সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্তরা সিন্ডিকেট গড়ে তুলে অসাধ্য কাজ সাধন করে থাকেন। এই সিন্ডিকেটে রয়েছেন কামাল হোসেন, মাসুদ হাসানসহ অনেকে।
এদিকে ঝিনাইদহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস দালাল ও হয়রানি মুক্ত দাবির একদিন পর র্যাব-৬ একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে ১১ দালালকে আটক করে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে প্রত্যেককে একমাস করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হযেছে। আটকরা হলেন লাল চাঁদ, দিপংকর, স্বপন কুমার, শামছুল, আনোয়ার, সাধন, তাজুল, সজল, জিল্লুর রহমান, টরি ও জয়দেব কুমার।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী উপ-পরিচালক আব্দুল মোত্তালেব সরকার ঢাকাটাইমসকে জানান, কে কীভাবে টাকা নিচ্ছে আমার জানা নেই। যারা টাকা দিচ্ছেন তাদের আমার কাছে আসতে বলেন। নিজের অফিস দালাল ও হয়রানিমুক্ত দাবি করে বক্তব্য দেয়ার একদিন পর ১১ দালাল আটক হলো কিভাবে? এমন প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে যান।