এখন ভোটের অধিকার জনগণের হাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । কাজেই নির্বাচিত সরকারই নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করবে। তিনি বলেন, ভোটের অধিকার এখন জনগণের হাতে। জনগণ যাদের ভোট দেবে তারাই সরকার গঠন করবে। এখন আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। এখন আমাদের সংবিধানও জনগণের ভোটাধিকার সুরক্ষিত করে। নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তে একটি নির্বাচিত সরকার (ক্ষমতায়) আসবে।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকার (ভোয়া) সঙ্গে আলাপকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য বিএনপির দাবির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। গতকাল শনিবার ভোয়ার ওয়েবসাইটে প্রধানমন্ত্রীর ওই ভিডিও সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ হয়েছে।

খালেদা জিয়ার চিকিৎসাবিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে হলে আগে জেলে যেতে হবে। তাকে আবার জেলে যেতে হবে এবং কোর্টে যেতে হবে। কোর্টের কাছে আবেদন করতে হবে। কোর্ট যদি রায় দেয়, তখন (বিদেশে) যেতে পারবেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র আরও স্যাংশন দিতে পারে বলে জানান তিনি। খবর বাসস ও বাংলানিউজের।

সাক্ষাৎকারকারী প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন, আপনি বলছেন সংবিধানে (সিজি) এর কোনও সুযোগ নেই। কিন্তু সংবিধান সংশোধন করার জন্য সংসদে তো আপনার প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। আপনি কি সংবিধান পরিবর্তন করে সিজি আনার কোনও উদ্যোগ নেবেন? নাকি বিরোধী দলের সঙ্গে কোনও আলোচনা করবেন?

শেখ হাসিনা বলেন, একসময় তারা (বিএনপি) এর (সিজি) বিরোধিতা করত। এখন তারা দাবি করছে, কিন্তু ভবিষ্যতে তারা কী করবে তা নিশ্চিত নয়। তাছাড়া বিএনপি এই (সিজি) ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা হাই কোর্টের বিচারকদের বয়স বাড়ানো, ১.২৩ কোটি ভুয়া ভোটার দিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়নসহ ইচ্ছেমতো সরকার বসানোর জন্য নানা ধরনের অপকর্ম করেছে। কোনোটাতেই কাজ হয়নি, কারণ জনগণ তা মেনে নেয়নি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি যখন ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে যায়, তখন আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (সিজি) জন্য আন্দোলন করেছিলাম। যখন ভোট চুরি হয়েছিল, তখন জনগণ তা চেয়েছিল (সিজি)। তখন বিএনপি নেত্রী বলেন, পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়, এটা তাদের বক্তব্য। তারা এর বিরুদ্ধে ছিল।

তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিষয় ছিল ২০০৮ সালে সিজির অধীনে নির্বাচন হয়েছিল। কারণ বিএনপি ২০০১ থেকে ২০০৬ মেয়াদে তাদের বিভিন্ন অপকর্মের কারণে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, মানি লন্ডারিং এবং জরুরি অবস্থা জারি করেছিল। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসে। কিন্তু তারা দুই বছর নির্বাচন দেয়নি, বরং আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে।

তিনি বলেন, ২০০৮ সালে যখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন তাও সিজির অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেই নির্বাচনে বিএনপি কতটি আসন পেয়েছিল? জামায়াতসহ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ২৯টি আসন পেয়েছে এবং তারপর তারা পুনরায় নির্বাচনে আরেকটি আসন পায়, ফলে তাদের আসন সংখ্যা ৩০ হয়। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে তারা এই পরিস্থিতির প্রত্যক্ষ করেছে।

শেখ হাসিনা বলেন, এজন্য তারা ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন এবং তা বানচাল করতে আগুন সন্ত্রাস করেছিল। আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা ৩ হাজারের বেশি মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে। হাজার হাজার গাছ কেটেছে, রাস্তা কেটেছে, ৫শটিরও বেশি ভোটকেন্দ্র ও স্কুল পুড়িয়ে দিয়েছে, বোমা মেরে আদালতে বিচারক হত্যা করেছে। তারপর ২০১৮ সালের নির্বাচন এল এবং তারা এতে অংশগ্রহণ করেছে। ৩০০টি আসনে প্রায় ৭৫০টি মনোনয়নপত্র ছিল।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারণ একটি মনোনয়ন এসেছে লন্ডন থেকে, আরেকটি তাদের গুলশান অফিস থেকে এবং অন্যটি এসেছে পুরানা পল্টন অফিস থেকে। তিনি বলেন, এভাবে যখন প্রতিটি আসনে দুই বা তিনজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল, তারা গণ্ডগোল করে নির্বাচন থেকে সরে যায়। সে নির্বাচনেও তারা ব্যর্থ হয়। নির্বাচনে তারা মাত্র কয়েকটি (সিট) জিতেছে।

বিএনপি কখনোই অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন করেনি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা সুষ্ঠু নির্বাচন চায় না। তারা হঠাৎ সিজির দাবি করছে কেন? প্রশ্ন হলো, তাদের নেতা কে? জনগণ কাকে ভোট দেবে? জনগণ এমন একজন নেতা দেখতে চায়, যিনি ভোট দিলে আগামীতে এই দেশ পরিচালনা করবেন। এমন কাউকে সামনে আনতে পেরেছেন যাকে নিয়ে তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন?

শেখ হাসিনা বলেন, এখন পর্যন্ত বিএনপি–জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোট আছে, কিন্তু তাদের নেতৃত্ব কোথায়, যারা দেশ পরিচালনা করবে। তৃতীয় বিষয় হলো নির্বাচন। এটা জনগণের ভোটের অধিকার।

তিনি বলেন, ২০০৭ সালে যখন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয় তখন হাই কোর্টের একটি রায়ের পরে তা করা হয়। এতে বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশে কোনো অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসতে পারবে না এবং একটি নির্বাচিত সরকারকে অন্য নির্বাচিত সরকার দ্বারা প্রতিস্থাপিত করতে হবে।

তিনি উল্লেখ করেন, সংবিধান লঙ্ঘন করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলকে অবৈধ ঘোষণা করা হয় এবং সামরিক আইনের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদের শাসনকেও অবৈধ ঘোষণা করা হয়। ওই রায়ে বলা হয়েছে, নির্বাচিত নয় এমন কেউ সরকারে আসতে পারবে না।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই রায় ঘোষণা করেছে। ‘সেই বিবেচনায় সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে এই রায় কার্যকর করা হয়েছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন সর্বোচ্চ আদালতের ওই রায় থেকে আমরা কীভাবে সরে আসব বা কীভাবে আবার সংবিধান সংশোধন করব?

তিনি বলেন, কেন আমরা এটা করব? তিক্ত অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর আগে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো হলো মার্শাল ল’– সামরিক একনায়কত্ব। তাদের অধীনে নির্বাচনী প্রহসন, তারপর আবার সিজির অধীনে নির্বাচনী প্রহসন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এই ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটেছে।

তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ২০০৯ সালে সরকার গঠিত হয় এবং আজ ২০২৩ সাল পর্যন্ত স্থিতিশীল পরিস্থিতি রয়েছে। বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, সংঘাত, আগুন সন্ত্রাসসহ অনেক কিছুই করা হয়েছে অস্থিতিশীল করার জন্য।

শেখ হাসিনা বলেন, সকলকে মোকাবেলা করে বাংলাদেশ যখন আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথে এগিয়েছে এবং উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে, তখন তা বাস্তবায়ন করা একান্ত অপরিহার্য। যেখানে আমাদের একটি নির্বাচিত সরকার দরকার, সেখানে মাঝখানে আমি কি অনির্বাচিত সরকার আনব?

বিদেশ যেতে চাইলে খালেদাকে আগে জেলে যেতে হবে : সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রীকে সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতির খবর আমরা পাচ্ছি। তাকে উন্নততর চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি আপনারা কী পুনর্বিবেচনা করবেন?

জবাবে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়েন শেখ হাসিনা, আমি জিজ্ঞেস করি, পৃথিবীর কোন দেশ সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে পেরেছে? পৃথিবীর কোনো দেশ দেবে? খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার বিষয়টি আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল বলে জানান তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদেরকে যদি চাইতে হয়, তাহলে আবার আদালতে যেতে হবে। আদালতের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। আদালতের কাজের ওপর আমাদের হস্তক্ষেপ করার কোনো সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাও স্পষ্ট করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, হ্যাঁ, তার (খালেদা জিয়া) জন্য যেটুকু করতে পেরেছি সেটা হচ্ছে, সরকার হিসেবে আমার যেটুকু ক্ষমতা আছে, আমি তার সাজা স্থগিত করে তাকে বাড়িতে থাকার পারমিশন দিয়েছি এবং তার চিকিৎসা ব্যবস্থা করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি নিজেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। বাংলাদেশের সব থেকে দামি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর যদি তাকে বাইরে যেতে হয়, (তাহলে) তাকে আমি বাসায় থাকার যে পারমিশনটা দিয়েছি; এটা আমাকে উইথড্র করতে হবে। ফলে তাকে আবার জেলে যেতে হবে এবং কোর্টে যেতে হবে। কোর্টের কাছে আবেদন করতে হবে। কোর্ট যদি রায় দেয়, তখন যেতে পারবেন। এটা হলো বাস্তবতা।

যুক্তরাষ্ট্র আরও স্যাংশন দিতে পারে : বাংলাদেশে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আরও স্যাংশন দিতে পারে, এটা তাদের ইচ্ছা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কী কারণে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে?

ভোটের অধিকারের বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ ভোটের অধিকার নিয়ে সংগ্রাম করেছে। অনেক নেতাকর্মী রক্ত দিয়েছে, এই ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যত ধরনের সংস্কার দরকার সেটা আমরাই করেছি। ছবিসহ ভোটার তালিকা, স্বচ্ছ ব্যালট বাঙ। মানুষের ভোটের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা।

আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব–এই স্লোগান আমার দেওয়া প্রধানমন্ত্রী বলেন। আমি এভাবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছি। সেক্ষেত্রে ভোট নিয়ে হঠাৎ স্যাংশন দেওয়ার কোনো যুক্তি আছে বলে আমি মনে করি না।

তিনি বলেন, দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী আমার কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্থার কেউ যদি কোনো অন্যায় করে তার কিন্তু বিচার হয়। এই বিচারে কিন্তু কেউ রেহাই পায় না।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031