কখনো দুই বছর, কখনো পাঁচ বছর তার খোঁজ পাওয়া যায় না। সর্বশেষ প্রায় ২৭ বছর ধরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কার্যত নিখোঁজ ছিলেন তিনি। মাঝেমধ্যে উধাও হয়ে যান বাঁশখালীর মো. হাসান (৬১)। তিনি মারা গেছেন ভেবে পরিবারের সদস্যরাও ইউপি চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেছিলেন পৈত্রিক সম্পত্তি তাদের নামে লিখে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। এর মধ্যে হঠাৎ করে তার আগমনে রীতিমতো ক্ষুদ্ধ তার স্ত্রী–সন্তানেরা। নিজের নামে থাকা সম্পত্তি লিখে দেওয়ার জন্য হাসানকে চাপ দিয়েছিলেন তারা। রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত স্ত্রী–সন্তানেরা ঠান্ডা মাথায় তাকে খুন করেন।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) একেএম মহিউদ্দিন সেলিম বলেন, নগরীর পতেঙ্গা থানা এলাকায় লাগেজে পাওয়া খণ্ডবিখণ্ড মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করতে গিয়ে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্যের খোঁজ পেয়েছি যে, আমার পুলিশে চাকরিজীবনে এমন নৃশংস ঘটনা দেখেছি হাতেগোনা দুই–তিনটি। ভাবছি এ সম্পত্তি এখন কে ভোগ করবে? ঘটনায় জড়িত ভুক্তভোগীর স্ত্রী ছেনোয়ারা বেগম ও ছেলে মোস্তাফিজুর রহমানকে আটক করা হয়েছে। তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছি, পরিকল্পিতভাবে লাশ টুকরা টুকরা করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেন তারা, যেন পরিচয় না পেয়ে হত্যাকাণ্ডের রহস্য গোপন থাকে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছোট ছেলে সফিকুর রহমান জাহাঙ্গীর ও তার স্ত্রী আনারকলির খোঁজে অভিযান চলছে।
এদিকে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নগরীর আকমল আলী রোডে নালায় হাসানের দেহের কোমর থেকে গলা পর্যন্ত অংশ পাওয়া যায়। তবে মাথাটি এখনো পাওয়া যায়নি।
গত ২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে নগরীর পতেঙ্গা বোট ক্লাবের অদূরে ১২ নম্বর গেটে একটি ট্রলিব্যাগ পাওয়া যায়। কফি রঙের ট্রলিব্যাগে ছিল মানব শরীরের ৮টি খণ্ড। এর মধ্যে ছিল দুই হাত, দুই পা, কনুই থেকে কাঁধ এবং হাঁটু থেকে উরু পর্যন্ত অংশ। প্রত্যেকটি অংশ টেপ দিয়ে মোড়ানো ছিল। তবে ওই লাগেজে ভুক্তভোগীর মাথা না থাকায় তাৎক্ষণিক পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় পতেঙ্গা থানার উপ–পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল কাদির বাদী হয়ে এক বা একাধিক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এদিকে খণ্ডিত এই মরদেহের পরিচয় শনাক্ত ও রহস্য উন্মোচনে মাঠে নামেন পিবিআইয়ের কর্মকর্তারা। তারা প্রথমে ফিঙ্গারপ্রিন্টের সহায়তায় নিহত ব্যক্তি মো. হাসান বলে শনাক্ত করেন। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী হাসান বাঁশখালী উপজেলার কাথরিয়া এলাকার সাহেব মিয়ার ছেলে। তার বর্তমান ঠিকানা লেখা আছে সিলেট সদরের সাধুর বাজার সংলগ্ন রেলওয়ে কলোনি এলাকা।
অভিযানে অংশ নেওয়া পিবিআই ইন্সপেক্টর মো. ইলিয়াস বলেন, আঙুলের ছাপ এবং নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে আমরা প্রথমে হাসানের পরিচয় নিশ্চিত হই। এরপর আকমল আলী রোডে তার ছোট ছেলের বাসার সন্ধান পাই। ওই বাসার আশেপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহের পর পুরো বিষয়টি আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়েছে। গত ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে নগরীর ইপিজেড থানার আকমল আলী সড়কের পকেট গেট এলাকার জমির ভিলার ৭ নম্বর বাসায় চিকিৎসার নামে হাসানের স্ত্রী চট্টগ্রাম শহরে ছোট ছেলের বাসায় আসেন। ঘটনার দিন বড় ছেলে মোস্তাফিজুরও সেই বাসায় যান। হাসানকেও ডেকে নেওয়া হয়। রাতে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে স্ত্রী, দুই ছেলে এবং ছোট ছেলের স্ত্রী মিলে পরিকল্পিতভাবে তাকে খুন করেন। ঠান্ডা মাথায় লাশ কেটে টুকরা করে ট্রলিব্যাগে করে আট টুকরা ফেলা হয় পতেঙ্গা ১২ নম্বর ঘাট এলাকায় খালে। মাথা ও বুকসহ শরীরের আরও কিছু অংশ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলা হয়েছে। ছোট ছেলেই তার বাবার শরীরের টুকরাগুলো বিভিন্ন স্থানে ফেলেন। তিনি বলেন, সিসিটিভি ফুটেজে আকমল আলী রোডের সেই বাসা থেকে হাসানের ছেলেকে বস্তায় ভরে মরদেহ বের করতে দেখা যায়।