পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস গত ত্রিশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে । গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকে পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় এ বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়। এছাড়া চলতি আগস্ট মাসে চট্টগ্রামের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ৫৩০ দশমিক ৬ মিলিমিটার। কিন্তু গত ৬ দিনে রেকর্ড হয় ৫৪৭ মিলিমিটার। অর্থাৎ পুরো মাসের বৃষ্টিপাতেও রেকর্ড হয়েছে। অবশ্য পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের রেকর্ডকৃত বৃষ্টিপাত মূলত পতেঙ্গা–বন্দর এবং সাগরের হওয়া বৃষ্টির পরিমাণ নির্ণয় করে। শহর এলাকার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে আমবাগান আবহাওয়া অফিস। সেখানে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড হয় ২১২ মিলিমিটার। রেকর্ড বৃষ্টিপাত এবং জোয়ারের পানিতে গতকাল রোববারও তলিয়ে যায় শহরের নিচু এলাকা। এই নিয়ে টানা তিনদিন জলাবদ্ধতার দুর্ভোগে ছিল নগরবাসী। কোনো কোনো জায়গায় পানির উচ্চতা এবং জলাবদ্ধতার স্থায়িত্ব আগের দুই দিনের চেয়ে বেশি ছিল বলে জানান সাধারণ মানুষ। ফলে ভোগান্তিও ছিল বেশি। টানা তিন ধরে জলাবদ্ধতায় কষ্ট পাওয়া লোকজনের মন্তব্য ছিল ‘শঅর পানিত বা’আর’। জলাবদ্ধতা নিরসনে নগরে চলমান আছে সিডিএ’র মেগা প্রকল্পের কাজ। ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সমপ্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক মেগা প্রকল্পটি ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকায় ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট একনেকে অনুমোদন পেয়েছিল।
২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সিডিএর সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। একই বছরের ২৮ এপ্রিল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ইতোমধ্যে ৭৬ শতাংশ ভৌত কাজ শেষ হয়েছে। এরপরও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না নগরবাসী। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করে শিহাব নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বলেন, ‘৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পেও সুফল আসেনি। বরং নগরীর কোথাও কোথাও জলাবদ্ধতা আরো বেড়েছে।’
এদিকে চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল হাশেম আজাদীকে বলেন, ‘সিডিএ তাদের প্রকল্পের আওতাধীন খাল থেকে যে পরিমাণ মাটি ( ৯.৫ লক্ষ কিউবিক মিটার) উত্তোলনের কথা তার চার ভাগের এক ভাগ মাটিও তুলে নাই। খালের প্রশস্থতাও কমিয়েছে রাস্তা করার জন্য, অন্যদিকে খালের গভীরতাও কমেছে প্রয়োজনীয় পরিমাণ মাটি উত্তোলন না করার কারণে। ফলে পানির স্পেস কমে গেছে। আরেকটা কারণ হলো স্লুইচগেট সমূহ এক্টিভ করা হয়নি এবং পানি পাম্প আউট করার জন্যও কোনো ব্যবস্থা এ পর্যন্ত করে নাই। ফলে পানি স্লো নামছে। এটাই মূলত জলাবদ্ধতার কারণ।’
গত শনিবার রাতেও থেমে থেমে বৃষ্টি হয়। এরপর সকাল থেকে থেমে মাঝারী ও ভারী বৃষ্টি হয়েছে দিনভর। এদিকে রেকর্ড বৃষ্টির সঙ্গে ছিল উচ্চ জোয়ার। দুয়ের সম্মিলনে তলিয়ে গেছে শহরের নিচু এলাকা। রাস্তাঘাট ও অলিগলিতে ছিল হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি। বাসা–বাড়ির নিচতলায় পানি ঢুৃকে যায়। এতে দুর্ভোগ বাড়ে সাধারণ মানুষের।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, চকবাজার মোহাম্মদ আলী শাহ শাহ দরগাহ লেইন, নাজিরপাড়া, সুন্নিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন এলাকা, বড়পোল এলাকা, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, তিন পুলের মাথা, রিয়াজউদ্দিন বাজার, মুরাদপুর, চাক্তাই–খাতুনঞ্জের নিচু এলাকা, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, দেওয়ান বাজার, খলিফাপট্টি, মুরাদপুর, ২ নম্বর গেট, বহদ্দারহাট, বাদুরতলা, শুলকবহর, মোহাম্মদপুর, কাপাসগোলা, চকবাজার, কাতালগঞ্জ, বাকলিয়ার বিভিন্ন এলাকা, ফিরিঙ্গিবাজারের একাংশ, কাতালগঞ্জ, শান্তিবাগ আবাসিক এলাকা, কে বি আমান আলী রোড, চান্দগাঁওয়ের শমসের পাড়া, ফরিদার পাড়া, পাঠাইন্যাগোদা, মুন্সীপুকুর পাড়, এছাড়া চকবাজার, কাতালগঞ্জ, বহদ্দারহাট, শুলকবহর, ফুলতলা, ডিসি রোড, , চকবাজার কাঁচাবাজার, হাসমত মুন্সেফ লেন, কমার্স কলেজ সংলগ্ন এলাকা, বাকলিয়া মিয়া খান নগর, কে বি আমান আলী সড়ক, সৈয়দ শাহ সড়ক, আল ফালাহ গলি, পুরোনো চান্দগাঁও থানা এলাকা, রিয়াজউদ্দিন বাজার, সাগরিকা ও আকমল আলী সড়ক ও হালিশহরসহ বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যায় পানিতে। এসব এলাকার বাসাবাড়ি, মসজিদ, বিপণিবিতান, দোকানপাট ও সড়ক ডুবে যায়। বিকেলে বৃষ্টি থামলে পানি নেমে যায় বেশিরভাগ এলাকার। তবে রাতে চকবাজারসহ অনেক এলাকায় পানি জমেছিল।
স্থানীয়রা জানান, খলিফাপট্টির বিভিন্ন বাসা–বাড়িতে পানি ঢুকে গেছে। মুরাদপুর মোহাম্মদপুর এলাকার বিভিন্ন বাসা–বাড়ি এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও পানি ঢুকে। চকবাজার কাপাসগোলা, বাকলিায়সহ বেশ কয়েকটি এলাকায় বাসা–বাড়িতে পানি ঢুকে যাওয়ায় রান্নাসহ অন্যান্য নিত্য কাজকর্ম ব্যাহত হয়।
এদিকে কর্মস্থলমুখী লোকজনের দুর্ভোগ ছিল সীমাহীন। সকালে রাস্তাঘাটে গণপরিবহনের সংখ্যা ছিল কম। তাই বাধ্য হয়ে রিকশা ও ভ্যানে চড়ে কর্মস্থলে যান অনেকে। এতে অতিরিক্ত ভাড়া গুণতে হয় তাদের।
গতকাল সকালে পশ্চিম বাকলিয়া মৌসুমী আবাসিক এলাকায় একটি ভবনে দেখা যায় নিচতলায় প্রায় কোমর সমান পানি। এসময় ফারুক নামে এক বাসিন্দাকে দেখা যায় ঘরের প্রয়োজনীয় মালামাল দ্বিতীয় তলায় তুলছেন। তিনি বলেন, আমি ভাড়াটিয়া। আজ রাতে দ্বিতীয় তলায় ভবনের মালিকের বাসায় থাকব।
মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা নজরুল আজাদীকে বলেন, বন্ধ থাকায় গত দুই দিন অফিসে যাইনি। আজ বের হয়ে দেখি রাস্তায় প্রায় এক কোমর পানি। গাড়ি নেই। হেঁটেই আগ্রাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি। পানি শেষ করে তারপর হয়ত গাড়ি পাব। মো. হাসান বলেন, আজকে শহরের নতুন নতুন জায়গায় পানি উঠেছে। সল্টগোলা থেকে ইপিজেড পর্যন্ত রোডেও পানি উঠে গেছে।
এদিকে আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে আজও ভারী বর্ষণ হতে পারে। এতে কোথাও কোথাও ভূমি ধসের সম্ভাবনা রযেছে বলেও জানানো হয়।