তেঁতুলিয়া, বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে রুপালি ইলিশ ফেনী নদী ও ভোলার মেঘনা। চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায় ইলিশ কম ধরা পড়লেও মাছঘাটে আসছে বিভিন্ন এলাকার ইলিশ। এতে দীর্ঘ অপেক্ষার পর মাছের সন্ধানে ঘুরতে থাকা জেলে ও মহাজনদের মুখে হাসি ফুটেছে। কর্মচাঞ্চল্যে ফিরেছেন মৎস্যজীবী ও মাছ ব্যবসায়ীরা। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত-
ফেনী প্রতিনিধি জানান, ফেনী নদীতে ধরা পড়ছে বড় বড় ইলিশ। ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় স্থানীয় জেলেদের জালে ৫০টি ইলিশ ধরা পড়ে। বেশিরভাগ ইলিশের ওজন দুই থেকে আড়াই কেজি পর্যন্ত। মাছের প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞা মেনে চলায় জেলেরা এখন উপকৃত হচ্ছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইলিশ ধরতে তিনটি ট্রলার ও নৌকা নিয়ে ফেনীর আদর্শগ্রাম এলাকার মো. আবদুল খালেক, নুর নবী, আবদুল শুক্কুরসহ ১৫-২০ জেলে বড় ও ছোট ফেনী নদীর শেষপ্রান্তে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জাল ফেলেন। দুপুর হওয়ার পর জোয়ার কমতে থাকায় জালে টান মারলে তারা বুঝতে পারেন, বড় কিছু আটকা পড়েছে। জাল টেনে নৌকায় তুলতেই সবাই দেখতে পান, বড় বড় ইলিশ ধরা পড়েছে।
এর মধ্যে ১০টির ওজন আড়াই কেজি, ২১টির ওজন ২ কেজির বেশি। এ ছাড়া ১ কেজি ১৫০ গ্রাম থেকে সাড়ে ৯০০ গ্রামের আরও ১৯টি ইলিশ একই জালে আটকা পড়ে। অন্য তিনটি জালে ধরা পড়ে ছোট-বড় আরও প্রায় দুই মণ ইলিশ।
আবদুল খালেক বলেন, ‘পৌর শহরের পাইকারি মাছ বিক্রেতা আবদুল মান্নান, নেয়ামত উল্যাহসহ তিন ব্যবসায়ী যৌথভাবে তাদের সাড়ে ৪ মণ ইলিশ ৩ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকায় কিনে নেন।’
মৎস্য ব্যবসায়ী আবদুল মান্নান জানান, মাছগুলো বিক্রি করতে পৌর শহরের মাছবাজারে নিয়ে আসেন তারা। নদীর তীরে ও বাজারে উৎসুক অনেকে বড় ইলিশগুলো দেখতে ভিড় করেন। আড়াই কেজি ওজনের ইলিশ ২ হাজার ২০০ টাকা, ২ কেজির ইলিশ ২ হাজার ও ১ কেজির ইলিশ ১ হাজার ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
গত বছর এ সময় বড় ও ছোট ফেনী নদীতে ইলিশ ছাড়াও কোরাল, বোয়াল, কাতলা, পাঙাশ, বাগাড়, ১০ মণ ওজনের একটি শাপলাপাতা মাছসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরা পড়েছিল বলে জানান জেলেরা। নদীর এসব মাছ সুস্বাদু। এগুলোর দামও বেশি পাওয়া যায়। তবে এ বছর এখনো তিন কেজি ওজনের ইলিশ ছাড়া অন্য বড় মাছ ধরা পড়েনি।
নদী ও সাগরের বিভিন্ন প্রজাতির মাছের বংশবিস্তার বেড়েছে জানিয়ে মৎস্য কর্মকর্তা তূর্য সাহা সাংবাদিকদের বলেন, ‘সরকারি বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা মেনে চলায় স্থানীয় জেলেরা উপকৃত হচ্ছেন। ফলে নদীতে টানা ও বসানো জালে এখন বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর পরিমাণ মাছ ধরা পড়তে শুরু করেছে।’ স্টাফ রিপোর্টার ভোলা থেকে জানান, বিলম্বে হলেও ভোলার মেঘনা, তেঁতুলিয়া ও বঙ্গোপসাগরে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে রুপালি ইলিশ। এতে এ মাছের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে আশা করছে মৎস্যবিভাগ। প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ায় মুখে হাসি ফুটেছে জেলেদের। সরগরম হয়ে উঠেছে ইলিশের আড়তগুলো।
জানা গেছে, প্রতিদিন প্রায় কোটি টাকার মাছ বিক্রি হচ্ছে। নদী ও সাগরে ইলিশের এমন প্রাপ্যতা অব্যাহত থাকলে বিগত দিনের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে জানিয়ে জেলেরা বলেন, সাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে উপকূল জুড়ে বেড়েছে বৃষ্টিপাত। এতেই জালে উঠছে ইলিশ। ঘাটে ঘাটে বেড়েছে ব্যস্ততা। বেড়েছে কেনাবেচা।
ভোলার চরফ্যাশনের সাগর উপকূলের স্লুইস ঘাট, মাদ্রাস ও সামরাজসহ বিভিন্ন ঘাট ঘুরে দেখা গেছে, জেলে ও মৎস্যজীবীদের ব্যস্ততা। কেউ বরফ ভাঙছেন কেউ ঝুড়ি বা ককশিটে ইলিশ সংরক্ষণ করছেন। কেউ ব্যস্ত কেনাবেচা নিয়ে।
মনির, ইলিয়াস, লোকমান ও সিরাজ মাঝিসহ কয়েকজন জেলে জানান, ‘গত ৩ দিন ধরে মেঘনা ও সাগর মোহনায় ইলিশ ধরা পড়ছে। এ অবস্থা থাকলে তাদের বিদ্যমান সংকট দূর হবে। অনেকেই এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। সেগুলো মিটিয়ে দিতে পারবেন।’
ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ায় ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে জানিয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্ল্যাহ বলেন, ‘বৃষ্টি বাড়ায় সাগর থেকে নদীতে চলে আসছে ইলিশ। ফলে জেলেরা মাছ পাচ্ছেন। কয়েকদিনের মধ্যে আরও বেশি মাছ ধরা পড়বে। এতে করে জেলেদের সব সংকট কেটে যাবে। উৎপাদন ও সরবরাহ অব্যাহত থাকলে বাজারে মাছের দামও কমবে।’
চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, পদ্মা-মেঘনায় ইলিশের তেমন দেখা না মিললেও সাগর মোহনা থেকে দেশের অন্যতম বৃহৎ ইলিশের আড়ত চাঁদপুর বড় স্টেশন মাছঘাটে ইলিশ আসতে শুরু করেছে। এই ইলিশ আসাকে কেন্দ্র করে মাছঘাটে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে।
চাঁদপুর মাছঘাট ঘুরে দেখা যায়, বাজারে মাছের চেয়ে লোকের সংখ্যা বেশি। কিছুক্ষণ পর পরই ট্রাকে ও ট্রলারে মাছ আসছে ঘাটে। আড়তে তোলার পর নিলাম উঠছে। আড়তদাররা ছোট মাছ, বড় মাছ আর তাজা মাছ আলাদা করে স্তূপ করার পর ডাক তুলছেন।
আড়তদার মো. শবেবরাত বলেন, ‘এবার মৌসুমের শুরুতে ইলিশের তেমন দেখা না মিললেও গত ৩/৪দিন ধরে নোয়াখালী, ভোলা বরিশাল থেকে ট্রলার ও ট্রাকে করে কিছু কিছু ইলিশ আসছে। তবে মৌসুম অনুপাতে এবার অর্ধেকেরও কম ইলিশ এসেছে। অধিকাংশই আকারে ছোট। তবে চাঁদপুর অঞ্চলে জেলেদের জালে ধরা পড়া ইলিশ একটু বড়। এ জন্য এর দামও বেশি।
ইলিশ ব্যবসায়ী মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘চাঁদপুর মাছঘাটে অধিকাংশ ক্রেতারা আসেন চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনার তাজা ইলিশ নিতে। কিন্তু সেই পরিমাণ তাজা ইলিশ সরবরাহ নেই ঘাটে। এখানে এখন সাগর মোহনার ইলিশই বেশি পাওয়া যায়। চাঁদপুরের তাজা পাওয়া গেলেও আকারে বড়, দামও অনেক বেশি।’
বর্তমানে সাগর মোহনার ইলিশ ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায় মন কেনাবেচা চলছে। আর চাঁদপুরের তাজা ইলিশ ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায় কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে। এর চেয়ে বড় মাছ বেশি দামে এবং ছোট আকারের মাছ কম দামে কেনাবেচা হচ্ছে।
ঢাকার মিরপুর আদর্শ স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষিকা ফারহানা ইয়াসমিন চাঁদপুরের তাজা ইলিশ কিনতে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘হাজবেন্ডসহ প্রতি বছর চাঁদপুরে ইলিশ কিনতে আসি। কিন্তু ইলিশের অনেক দাম। তারপরও বড় দেড় কেজির একটি এবং এক কেজির তিনটি ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কিনেছি। ঢাকার বাজার অনুপাতে এখানকার মাছের দাম বেশি হলেও তাজাটা পেয়েছি।’
চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমিতি সভাপতি আব্দুল বারি মানিক জমাদার বলেন, ‘আমরা এই মৌসুমের প্রথম এক মাস বসে ছিলাম। আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তবে কদিন ধরে ইলিশ আসতে শুরু করলেও পরিমাণে গত বছরের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। তবে আমরা আশাবাদী আর প্রায় দু’মাস ইলিশের মৌসুম রয়েছে। আশা করি ক্ষতি পুষিয়ে যাবে।’