অস্থিরতা বিরাজ করছে ওষুধের দামে । মাসখানেকের ব্যবধানে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধের দাম ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ওষুধের পেছনে একেকজন রোগীর মাসিক খরচ ৪/৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে ওষুধের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের পক্ষে চিকিৎসা কার্যক্রম চালানো কঠিন হয়ে উঠেছে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ জীবন রক্ষাকারী নানা ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ রোগীদের দিশেহারা করে তুলেছে। কোনো কোনো ওষুধের দাম কয়েক মাসের মধ্যে তিন দফা বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিকে ভুগছেন মোহাম্মদ আবদুল্লাহ নামে হালিশহর এলাকার একজন বাসিন্দা। সকালে ও রাতে দুইবেলা ইনসুলিন নিতে হয় তাকে। আবাসাকলার ১০০ ইউ/এমএল বক্স ৩ হাজার ৩১৮ টাকা থেকে বেড়ে ৪ হাজার ১০৫ টাকা, হিউম্যালক ১০০ইউ/এমএল বক্স ৩ হাজার ৬শ টাকা থেকে ৪ হাজার ১০৫ টাকা হয়েছে। এতে তার এক মাসের ইনসুলিনের ব্যয় প্রায় দেড় হাজার টাকা বেড়ে গেছে। ইনসুলিনের পাশাপাশি অন্যান্য ওষুধের দামও বেড়ে গেছে।
ফার্মেসির ক্যাশ মেমো দেখিয়ে তিনি বলেন, এক মাসে তার ওষুধের খরচ বেড়ে গেছে অন্তত ৫ হাজার টাকা। ব্যাপারটিকে অস্বাভাবিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা একটি সাংঘাতিক ব্যাপার। তার অভিযোগ, দেশের অসুস্থ জনগোষ্ঠীকে জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। কোনো ধরনের মনিটরিং না থাকায় পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক হয়ে উঠেছে বলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
জানা গেছে, ডায়াবেটিসের ওষুধ, হিমুলিন ৪৩৫ টাকা থেকে ৫১০ টাকা, নিডল দিয়ে ব্যবহার্য হিমুলিন ৫৭০ টাকা থেকে তিন দফা দাম বাড়িয়ে বর্তমানে ৭৯০ টাকা করা হয়েছে। ডায়াবেটিসের পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের দামও বাড়ানো হয়েছে। দেশে ঘরে ঘরে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ ব্যবহৃত হয়। মাসখানেক আগে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় ব্যবহৃত কাভারসিল ৪ এমজির ট্যাবলেট ১ পাতা (৩০টি) বিক্রি হতো ৪৯০ টাকায়। গতকাল তা বিক্রি হয়েছে ৫৫০ টাকা। বাইজোরান ৫/২০ (এক বক্স–৬০টি ট্যাবলেট) কিছুদিন আগেও ছিল ২৭০ টাকা। গত কয়েকদিন ধরে নেয়া হচ্ছে ৩৩০ টাকা। বাইজোরান ৫/৪০ বক্স ছিল ৫০০ টাকা, এখন নেয়া হচ্ছে ৬০০ টাকা। এইচ সিরাপ ২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে ৩৫ টাকায়, নাপার মতো সাধারণ ওষুধও পাতা ৮ টাকা থেকে হয়েছে ১২ টাকা।
অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের দাম নিয়েও চলছে স্বেচ্ছাচারিতা। সেফাক্লাভ ৫০০ মিলিগ্রাম প্রতিটি ওষুধের ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬০ টাকা করা হয়েছে। একজন রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিকের এক কোর্স সম্পন্ন করতে আগের তুলনায় পাঁচশ টাকার বেশি অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হচ্ছে।
ভিটামিন জাতীয় ট্যাবলেট নিউরো–বি প্রতি প্যাকেট (৩০ পিস) ২৭০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। ক্যালসিয়াম সমস্যাজনিত ক্যালসিয়াম কার্বোনেট+ভিটামিন ডি ট্যাবলেট প্রতি পিস ১০ টাকা থেকে বেড়ে ১১ টাকা হয়েছে। এছাড়া জীবন রক্ষাকারী কিছু বিদেশি ওষুধের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে।
সেফুরোঙাইম নামের গ্রুপের বিভিন্ন ওষুধ ইনফেকশনের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। এসব ওষুধের দাম গত চার মাসে তিন দফা দাম বেড়েছে। ৫৫ টাকার প্রতি পিস ট্যবলেট গতকাল ৬৫ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। সেফিঙাইম গ্রুপের ২০০ মিলিগ্রামের প্রতিটি ক্যাপসুলের দাম ৪৫ টাকা থেকে ১০ টাকা বাড়িয়ে ৫৫ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। বিসোপ্রোলল ৫ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট দুই মাসের ব্যবধানে প্রতিটির দাম বেড়েছে দেড় থেকে দুই টাকা। ১০ টাকার ট্যাবলেট এখন সুযোগ বুঝে সাড়ে ১১ থেকে ১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অ্যামলোডিপাইন বেসিলেট ৫ মিলিগ্রামের ট্যাবলেট প্রতিটি ৫ থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা করা হয়েছে। ডঙোফাইলাইন ২০০ মিলিগ্রামের ট্যাবলেট প্রতি পাতার দাম ৬০ থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়েছে।
দেশীয় ওষুধের পাশাপাশি বিদেশি ওষুধের দামও বাড়ানো হয়েছে। সোলু মেড্রল নামের ৫০০ মিলি ইনজেকশনের দাম ২ হাজার ৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ৯০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা করা হয়েছে।
গতকাল একাধিক ফার্মেসিতে খবর নিয়ে জানা গেছে, এমন কোনো ওষুধ নেই যার দাম গত দুই–তিন মাসের মধ্যে বাড়েনি। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, লিভার, হৃদরোগ, হাঁপানি এবং গ্যাস্ট্রিকসহ জীবন রক্ষাকারী নানা ওষুধের দাম গড়ে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনো কোনো ওষুধের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। অতি সাধারণ এবং ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হয় এমন ওষুধগুলোর দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে।
সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে প্রেরিত পুলিশের একটি প্রতিবেদনে বিভিন্ন ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্যারাসিটামল ৫০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেটের মূল্য ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ২০ পয়সা করা হয়েছে। এছাড়া প্যারাসিটামল ৫০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট (র্যাপিড) ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৩০ পয়সা, প্যারাসিটামল ৬৫০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট (এঙআর) ১ টাকা ৩১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ২০ পয়সা, প্যারাসিটামল ৬৫০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট (এঙআর) ১ টাকা ৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ২৫ পয়সা, প্যারাসিটামল ৮০ মিলিগ্রাম ড্রপস ও ১৫ মিলিলিটার বোতল ১২ টাকা ৮৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা, প্যারাসিটামল ৮০ মিলিগ্রাম ড্রপস ও ৩০ মিলিলিটার বোতল ১৮ টাকা বাড়িয়ে ৩০ টাকা, প্যারাসিটামল ১২০ মিলিগ্রাম/৫ মিলিলিটার সাসপেনশন/৬০ মিলিলিটার বোতল ১৮ টাকা বাড়িয়ে ৩৫ টাকা, প্যারাসিটামল ১২০ মিলিগ্রাম/৫ মিলিলিটার সাসপেনশন/১০০ মিলিলিটার বোতল ৩০ টাকা ৮০ পয়সা বাড়িয়ে ৫০ টাকা, মেট্রোনিডাজল ২০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট ৬০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা, মেট্রোনিডাজল ২৫০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট ৯২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ২৫ পয়সা, মেট্রোনিডাজল ৪০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট ১ টাকা ৩৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৭০ পয়সা, মেট্রোনিডাজল ৫০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট ১ টাকা ৬৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে দুই টাকা, মেট্রোনিডাজল ২০০ মিলিগ্রাম/৫ মিলিলিটার সাসপেনশন/৬০ মিলিলিটার বোতল ২৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৫ টাকা, মেট্রোনিডাজল ২০০ মিলিগ্রাম/৫ মিলিলিটার সানপেনশন/১০০ মিলিলিটার বোতল ৩৪ টাকা ৯২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪৫ টাকা, মেট্রোনিডাজল ৫০০ মিলিগ্রাম/১০০ মিলিলিটার ইনফিউশন/১০০ মিলিলিটার বোতল ৭৪ টাকা ৩৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮৫ টাকা, এমোঙিসিলিন বিপি ১২৫ মিলিগ্রাম/১.২৫ মিলিলিটার সাসপেনশন/১৫ মিলিলিটার বোতল ২৬ টাকা ৩৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩৫ টাকা, এমোঙিসিলিন বিপি ১২৫ মিলিগ্রাম/৫ মিলিলিটার সাসপেনশন/১০০ মিলিলিটার বোতল ৪১ টাকা ৪০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭০ টাকা, এমোঙিসিলিন বিপি ২৫০ মিলিগ্রাম/৫ মিলিলিটার সাসপেনশন–জিএস/১৫ মিলিলিটার বোতল ৬৭ টাকা ৯৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১০০ টাকা, এমোঙিসিলিন বিপি ২৫০ মিলিগ্রাম ক্যাপসুল ৩ টাকা ১৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা, এমোঙিসিলিন বিপি ৫০০ মিলিগ্রাম ক্যাপসুল ৫ টাকা ৯০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা ৪ পয়সা, এমোঙিসিলিন বিপি ৫০০ মিলিগ্রাম ইনজেকশন ২৪ টাকা ২০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৫৫ টাকা হয়েছে।
বিভিন্ন ফার্মেসির মালিকেরা বলেছেন, ওষুধের দাম বাড়ছে। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে এক ধরনের সংকট তৈরি করছে। ওষুধের কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ার অজুহাতেও নানাভাবে দেশের সাধারণ রোগীদের জিম্মি করা হচ্ছে তাদের অভিযোগ।
শীর্ষস্থানীয় ওষুধ কোম্পানির পদস্থ একজন কর্মকর্তা গতকাল বলেন, কাঁচামালের আমদানি ব্যয় বেড়েছে। ৮০ টাকার ডলার ১১৩ টাকায় ঠেকেছে। এতে করে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে ওষুধের দাম না বাড়িয়ে উপায় নেই। তিনি বলেন, দেশের ওষুধগুলোর ৯৫ শতাংশ কাঁচামালই বিশ্বের নানা দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। অপরদিকে দেশে এলসি খোলার ব্যাপারে ব্যাপক কড়াকড়িতে কাঁচামাল আমদানি কমে এক ধরনের সংকট তৈরি হয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে এবং কাঁচামাল আমদানি হচ্ছে। ডলারের মূল্য কমলে ওষুধের দাম কমে যাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।