কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’যানবাহন চলাচলের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে । দেশের প্রথম এই টানেলকে ঘিরে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ইতোমধ্যে আনোয়ারা উপজেলা প্রান্তে সংযোগ সড়কের দুই পাশে গড়ে উঠছে শিল্পকারখানা। টানেল চালু হলে কর্ণফুলী নদী পাড়ি দিতে সময় লাগবে মাত্র ৩ থেকে ৫ মিনিট। সময়ক্ষেপণ না হওয়ায় গতি পাবে অর্থনীতি। এ সংযোগ সড়ক এক সময় এশিয়ান হাইওয়ের অংশ হয়ে উঠবে।
এদিকে, পদ্মা সেতুর পর অর্থনৈতিক সম্ভাবনায় নতুন দিগন্ত নিয়ে আসছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। এটি বিনিয়োগ, অর্থনীতি, শিল্পায়ন, নগরায়ন, যোগাযোগ, কর্মসংস্থান এবং পর্যটন খাতে ব্যাপক অবদান রাখবে। বিশেষ করে এই টানেল হবে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এগিয়ে নেওয়ার সেতুবন্ধন। ইতোমধ্যে টানেলের আশপাশের এলাকায় নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের নতুন শাখা খোলাসহ ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়েছে। এটি চালু হলে চট্টগ্রাম নগরীর পরিধি বাড়বে। টানেলের এক প্রান্তে চট্টগ্রাম শহর, অপর প্রান্তে আনোয়ারা উপজেলা। শহরের খুব কাছে থাকলেও এই উপজেলা এতদিন অবহেলিত ছিল। টানেল চালুর মধ্য দিয়ে আরেকটি শহরে রূপ নিতে যাচ্ছে আনোয়ারা। ইতোমধ্যে আনোয়ারা উপজেলায় জমির দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
স্বপ্নের পদ্মা সেতুর পর বাংলাদেশের আরেকটি গৌরব এবং অনন্য স্থাপনা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। আগামী সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেল উদ্বোধন করবেন বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
এদিকে, সেপ্টেম্বর মাস উদ্বোধনের সম্ভাব্য সময় ধরে দিনরাত চলছে টানেলের ভেতরে ফায়ার ফাইটিং, লাইটিং ও কন্ট্রোল ব্যবস্থাপনার কাজ। এরই মধ্যে নদীর তলদেশে স্থাপন করা হয়েছে দু’টি টিউব। একটি টিউবে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে যাতে বিকল্প পথে গাড়ি চালানো যায়, সেটিরও কাজ চলছে। বাতি ও পাম্প স্থাপন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরির কাজও সমানতালে চলছে। নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক, ৭৭২ মিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার। এখন চলছে কর্ণফুলীর দক্ষিণ প্রান্তে আনোয়ারা অংশের টোল প্লাজা নির্মাণের কাজ। চট্টগ্রাম পতেঙ্গার নেভাল অ্যাকাডেমি প্রান্ত থেকে টানেলটি নদীর তলদেশ হয়ে চলে গেছে আনোয়ারার চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মাঝামাঝি স্থানে। এর প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ছাড়াও পর্যটন শহর কক্সবাজার এবং পার্বত্য জেলা বান্দরবানের সঙ্গে সেতুবন্ধন তৈরি করবে। দুই পাড়ের জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়ন হবে।
এদিকে, বঙ্গবন্ধু টানেলটি চালু হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের সঙ্গে নতুন একটি সড়ক যোগাযোগ চালু হবে। ফলে ঢাকা থেকে কক্সবাজার কিংবা চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাওয়ার দূরত্ব কমে আসবে। ভবিষ্যতে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গেও সংযোগ স্থাপন করবে এই টানেল। সেইসঙ্গে কর্ণফুলী নদীর পূর্বদিকে শহরাঞ্চলকে যুক্ত করে সেখানে উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে এটি। অন্যদিকে পশ্চিম দিকে চট্টগ্রাম মূল শহরের সঙ্গে সাগর ও বিমান বন্দরেরও দূরত্ব কমে আসবে। কম খরচে ভ্রমণ আরও সহজ হবে। আর দুই বন্দর থেকেই মাল পরিবহণ সহজ হবে। এছাড়া টানেলটি নির্মাণের পর চট্টগ্রাম বন্দরের সুযোগ-সুবিধা বাড়বে। যার কারণে গভীর সমুদ্র বন্দরের নির্মাণ কাজও এগিয়ে যাবে।
সেতু কর্তৃপক্ষ বলছে, টানেল চালু হলে চট্টগ্রাম শহরকে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ বা ‘এক নগর, দুই শহর’ এর মডেলে গড়ে তোলা হবে। টানেলটি দেশের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে উল্লেখ করে প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ বলেন, এই টানেল চালু হলে সেটি দেশের জিডিপিতে বার্ষিক শূন্য দশমিক ১৬৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করবে।
শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, টানেলটি চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন, কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে গড়ে তোলা ডিপ সি-পোর্টের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের সংযোগ স্থাপনসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। তারা আরও বলেন, টানেলটি চালু হলে চট্টগ্রাম হবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বাণিজ্যিক হাব। টানেলের ভেতর দিয়ে যানবাহন আনোয়ারা ও বাঁশখালী হয়ে কক্সবাজার যেতে পারবে। এতে ঢাকার সঙ্গে ৩৫ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রামের ১৫ কিলোমিটার দূরত্ব কমবে। ঢাকা থেকে ৭ ঘণ্টা এবং চট্টগ্রাম থেকে ৩ ঘণ্টায় কক্সবাজার যাওয়া যাবে।
কক্সবাজার সৈকতের ব্যবসায়ী আলম খান বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ হওয়ার পর এখানে পর্যটকের চাপ বহুলাংশে বাড়বে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যও চাঙা হবে। বিশেষ করে আনোয়ারার পারকি সৈকত ঘিরে পর্যটন শিল্পের আরও প্রসার হবে। চট্টগ্রাম শহর থেকে সহজে পর্যটকরা পারকি সৈকতে আসতে পারবেন। পর্যটক বাড়লে বাড়বে রাজস্ব আয়। সেইসঙ্গে তা আনোয়ারা উপজেলায় উপশহর গড়ে তোলার দুয়ারও খুলে দেবে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলেছেন, একটি বড় শহরের পাশে সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে উপশহর গড়ে ওঠে। একটি উপশহর গড়ে ওঠার প্রধান বাধা অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধু টানেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটাবে। তাই নগরীর কাছাকাছি আনোয়ারাকে উপশহর হিসেবে গড়ে তোলা সহজ হবে। কর্ণফুলী টানেল চালু হলে চট্টগ্রামের দৃশ্যপট বদলে যাবে। এ টানেলের নির্মাণ শেষে চীনের সাংহাই নগরীর মতো হবে চট্টগ্রাম।
অর্থনীতিবিদ ডক্টর আশুতোষ সরকার বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বদলে দেবে দেশের অর্থনীতির চিত্র। টানেল ঘিরে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানা থেকে বাড়বে আয়। বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হবে। বঙ্গবন্ধু টানেল জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক অবদান রাখবে। যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে দেশের শিল্প উন্নয়নে। বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হবে- এই প্রত্যাশাও একদিন বাস্তব রূপ পাবে। মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশে টানেল-কেন্দ্রিক প্রচুর শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। বলা যায় অর্থনীতি ও শিল্প উন্নয়নে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস জানান, টানেলকে ঘিরে কিছুদিন পর সমুদ্রের পাড়ে বে-টার্মিনাল চালু হবে। মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল পুরোদমে চালু হলে লাখ লাখ মানুষ সেখানে থাকবে, যার প্রভাব পড়বে নগরীতে। টানেলের অপর প্রান্তে আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেড, চীনা শিল্পাঞ্চল, মহেশখালীর মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরসহ চট্টগ্রামে চলমান মেগা প্রকল্পগুলো চালু হলে বাড়বে ব্যবসায়ীদের আসা-যাওয়া। সেইসঙ্গে বাড়বে যানবাহনের চাপ। টানেল চালু হলে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টি হবে। তাতে উদ্যোক্তারা আর্থিকভাবে লাভবান হবেন বেশি। গতি বাড়বে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে। বাড়বে বিদেশি বিনিয়োগ। সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান।
এদিকে, টানেল নির্মাণের আগে ২০১৩ সালে করা সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, টানেল চালুর পর এর ভেতর দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সে হিসাবে দিনে চলতে পারবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী যানবাহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ ১ লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরে টানেলটি নির্মাণ করা হচ্ছে। মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। চার লেনবিশিষ্ট দু’টি টিউবের প্রতিটির দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। গত বছরের ২৬ নভেম্বর টানেলের দক্ষিণ প্রান্তের একটি টিউবের কাজের সমাপ্তি উদযাপন করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া মূল টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক এবং আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি ফ্লাইওভার থাকছে। ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে আসা যানবাহনকে টানেল হয়ে পর্যটন শহর কক্সবাজার, বান্দরবানসহ নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে এই মহাসড়ক ব্যবহার করতে হবে। ভবিষ্যতে কক্সবাজারের মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর এবং চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর চালু হলে এই মহাসড়কে গাড়ি চলাচলের পরিমাণ বাড়বে।
২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণ কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৪৪৬ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা। পরবর্তীতে তা ১০ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৪২ কোটি টাকা করা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। বাকি ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে চীন সরকার। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ হারে ২০ বছর মেয়াদি এ ঋণ দিয়েছে। চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) টানেল নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এদিকে, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় আরও ৩ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। দ্বিতীয়বার সংশোধন করার এই প্রস্তাব অনুমোদন পেলে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়াবে ১০ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা হবে। প্রকল্পটির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।