ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভা রয়েছে নগরের ৩০ শতাংশ বাসা–বাড়িতে । এসব বাসা–বাড়ি এবং আশপাশে মশার প্রজনন উপযোগী কন্টেনারের ৩৭ ভাগই পজিটিভ। এডিস মশা নিয়ে পরিচালিত চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দপ্তরের জরিপে এসব তথ্য উঠে আসে। এতে দক্ষ মশকনিধন কর্মী দিয়ে কীটনাশক ছিটানোর সময় মনিটরিং টিম গঠন করে সুপারভিশন জোরদার করাসহ ৯ দফা সুপারিশও করা হয়।

প্রতিবেদনে কন্টেনার বলতে বুঝানো হয়, যেখানে পানি জমে থাকে বা যেসব উপকরণ মশার লার্ভা ছাড়ার উপযোগী। এর মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিক কন্টেনার, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিক ড্রাম, মাটির পাত্র, পানির হাউস, ফুলের টব, এলুমনিয়াম সীট, প্লাস্টিক বালতি ও লিফটের গর্ভে জমানো পানি। এছাড়া জমে থাকা পানিতে মশার লার্ভা ও পিউপা থাকলে সেগুলোকে পজিটিভ কন্টেনার বলা হয়। মশার ডিম থেকে লার্ভা হয়। লার্ভা থেকে মশাটি পিউপা’তে রূপান্তরিত হয়। পিউপা এক থেকে দুই দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ মশায় রূপান্তরিত হয়

জানা গেছে, হাউজ ইনডেক্স ৫ শতাংশ এবং ব্রুটিক ইনডেক্স ২০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে সতর্কবার্তা হিসাবে প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কার্যক্রম প্রণয়ন করা হয়। অথচ নগরে পরিচালিত জরিপে এ দুটো সূচকের মাত্রা অনেক বেশি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ব্রুটিক ইনডেক্স ৪৬ শতাংশ। ওয়ার্ড ভিত্তিক কীটনাশক ছিটানোর কার্যক্রম যথাযথভাবে করা হলে মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ সম্ভব এবং ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের হার কম হবে বলেও প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়। এছাড়া মশক নিধনের জন্য ব্যবহৃত কীটনাশকের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা হলে মশার বংশবিস্তার হ্রাস সহজতর হবে বলেও মন্তব্য করা হয়।

স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নগরে ডেঙ্গুর শনাক্তের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় মশা জরিপের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরপর গত ৮ থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত নগরের পৃথক ২১টি ওয়ার্ডে এ জরিপ চালানো হয়। গত রোববার বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কাছে জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। সার্ভের উপর ভিত্তি করে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের জন্য গতকাল সোমবার বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. মহিউদ্দিন সিটি কর্পোরেশনে একাটি চিঠিও দেন।

লার্ভা বেশি প্লস্টিক কন্টেনারে : জরিপে পরিত্যক্ত বিভিন্ন প্লাস্টিক কন্টেনারে জমানো পানিতে সর্বোচ্চ ২১ দশমিক ৬২ভাগ, পরিত্যক্ত টায়ারে ১৮ দশমিক ৯১ভাগ, প্লাস্টিক ড্রামে ১৭ দশমিক ৫৭ভাগ, মাটির পাত্রে ৮ দশমিক ১১ভাগ, পানির হাউস, ফুলের টব ও এলুমিনিয়াম সীটে ৬ দশমিক ৭৬ ভাগ, প্লাস্টিক বালতিতে ৩ দশমিক ৩৮ ভাগ এবং লিফটের গর্ভে জমানো পানিতে ২ দশমিক ৭ ভাগ এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ২ নং জালালাবাদ, ৩ নং পাঁচলাইশ, ৪ নং চান্দগাঁও, ৭ নং পশ্চিম ষোলশহর, ৮ নং শুলকবহর, ৯ নং উত্তর পাহাড়তলী, ১০ নং উত্তর কাট্টলী, ১১ নং দক্ষিণ কাট্টলী, ১২ নং সরাইপাড়া, ১৩ নং পাহাড়তলী, ১৪ নং লালখান বাজার, ১৫ নং বাগমনিরাম, ১৬ নং চকবাজার, ১৮ নং পূর্ব বাকলিয়া, ২২ নং এনায়েত বাজার, ২৪ নং উত্তর পাঠানটুলী, ২৬ নং উত্তর হালিশহর, ৩০ নং পূর্ব মাদারবাড়ি, ৩৩ নং ফিরিঙ্গিবাজার, ৩৪ নং পাথরঘাটা ও ৩৬ নং গোসাইলডাঙ্গা ওয়াার্ডে টানা ১৩দিন মশার প্রজনন স্থান জরিপ করা হয়। জরিপকৃত প্রতিটি এলাকায় এডিস মশার লার্ভা সনাক্ত করা হয় এবং কোনো কোনো ওয়ার্ডে লার্ভার ঘনত্ব অনেকাংশে বেশি বলে সার্ভে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

জানা গেছে, জরিপকারী দল ৩২০টি বাড়িতে জরিপ চালিয়ে ৯৭টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। এছাড়া ৪০০টি কন্টেনারের এর মধ্যে ১৪৮টি পজিটিভ সনাক্ত করা হয়। অর্থাৎ জরিপে এডিস মশার পজিটিভ প্রজনন স্থানের প্রাপ্যতার ভিত্তিতে পজিটিভ বাড়ির হার ৩০ দশমিক ৩১ ভাগ এবং পজিটিভ কন্টেনারের (পানিতে লার্ভা ও পিউপার উপস্থিতি) হার ছিল ৩৭ ভাগ।

জরিপকারী দলে ছিলেন বিভাগীয় কীটতত্ত্ববিদ মো. মফিজল হক শাহ, জেলা কীটতত্ত্ববিদ এনতেজার ফেরদাওস, বিভাগীয় এন্টোমোলজিক্যাল টেকনিশিয়ান মো. মাকসুদুর রহমান ও জেলা এন্টোমোলজিক্যাল টেকনিশিয়ান সৈয়দ মো. মঈন উদ্দীন।

৯ সুপারিশ : সার্ভে প্রতিবেদনে ৯টি সুপারিশ করা হয়। এগুলো হচ্ছে– চসিক এর প্রতিটি ওয়ার্ডে কমিটি গঠনপূর্বক আধুনিক ও সময়োপযোগী গাইড লাইনের ভিত্তিতে মশক নিধনের কার্যক্রম পরিচালনা করা। দক্ষ মশক নিধন কর্মীর দ্বারা কীটনাশক ছিটানোর সময় মনিটরিং টিম গঠন করে সুপারভিশন জোরদার করা। অফিস–আদালত ও বাসাবাড়ির আঙিনা, ছাদ ও আশপাশ এলাকা সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা এবং কোনো ধরনের পাত্রে ৩–৪ দিনের বেশি পানি জমতে না দেয়া। ব্যবহৃত পাত্রের গায়ে লেগে থাকা মশার ডিম অপসারণে পাত্রটি ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পরিষ্কার করা। জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিলবোর্ড প্রদর্শন, নিয়মিত মাইকিং, লিফলেট বা পোস্টার বিতরণ এবং কাউন্সিলিং করা। জনগণকে সম্পৃক্ত করে মশার প্রজনন স্থান নির্মূল করা। মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সমন্বিত কার্যক্রমের মাধ্যমে বছরব্যাপি জরিপ পরিচালনা করে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। লার্ভিসাইডিং (লার্ভা ধ্বংসকারী কীটনাশক ছিটানো) এবং এডালটিসাইডিং (পূর্ণাঙ্গ মশা ধ্বংসকারী কীটনাশক ছিটানো) সময়োপযোগী প্রয়োগ করা। এক্ষেত্রে সূর্যদোয়ের পরপর এবং সূর্যাস্তের পূর্বে এডালটিসাইডিং পরিচালনা করা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সাধারণত বদ্ধ পরিষ্কার পানি এডিস মশার প্রজনন স্থান। তবে নালা নর্দমায় পাশে সৃষ্ট বিভিন্ন পকেটে বা নালায় পরিত্যক্ত স্তুপকৃত যে কোনো কন্টেনারে জমে থাকা আংশিক স্বচ্ছ বা খানিকটা ঘোলাটে পানিতে এডিস মশা বংশ বিস্তারের জন্য ডিম দিতে পারে। এডিস মশা সরাসরি পানিতে ডিম পাড়ে না। পানির স্পর্শে থাকে এ রকম জায়গায় অর্থাৎ পানির পাত্রের গায়ের ভেজা অংশে বা পানিতে ভাসমান পাতায় এডিস মশা ডিম পাড়ে। এই ডিমগুলো শুকনো অবস্থায় ৬ থেকে ১২ মাস বেঁচে থাকতে পারে। ডিম দেয়ার দিন থেকে একটি এডিস মশা আট–দশ দিন বেঁচে থাকে।

বিভাগীয় কীটতত্ত্ববিদ মো. মফিজল হক শাহ  বলেন, হাউজ ইনডেঙ ৫ শতাংশের বেশি পেয়েছি। তাই আমাদের সতর্কবার্তা হিসেবে প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দিকে যেতে হবে। ইনডেঙের হার অনুযায়ী নগরে এডিস মশার উপস্থিতি ভয়াবহ কীনা জানতে চাইলে বলেন, ভয়াবহ বলা যাবে না। কারণ এখানে বিচ্ছিন্নভাবে বৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে বিভিন্ন কন্টেনারে পানি জমে থাকে। সেখানে মশার লার্ভা হচ্ছে। এটা বর্ষাকালে হতেই পারে। তিনি বলেন, জনগণকে সচেতন করার জন্য আমরা কিছু দিক নির্দেশনা দিয়েছি। সমন্বিতভাবে প্রতিরোধ করতে হবে।

জেলা কীটতত্ত্ববিদ এনতেজার ফেরদাওস আজাদীকে বলেন, নির্মাণাধীন ভবনে মশার লার্ভা বেশি পেয়েছি।

এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল হাশেম  বলেন, প্রতিদিন কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে। ক্রাশ প্রোগ্রাম চলছে। মশক নিধনের জন্য শ্রমিক বাড়িয়েছি। নতুন করে কীটনাশক সংগ্রহ করা হচ্ছে। বাসা–বাড়িতে মশার লার্ভা সনাক্ত করতে ড্রোনের ব্যবহার করা হচ্ছে। মানুষকে সচেতন করছি। এরপরও লার্ভা পাওয়া গেলে জরিমানা করা হচ্ছে।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ বিভাগের উদ্যোগেও সম্প্রতি একটি জরিপ চালানো হয়। এতে মশার প্রজনন এবং ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বিবেচনায় নগরে ৪৯০টি হটস্পট চিহ্নিত করা হয়।

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031