যানজটে দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয় শুধু ঢাকায় । যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। রাজধানীর এই অসহনীয় যানজটে শুধু মানুষের ভোগান্তি ও কর্মঘণ্টাই নষ্ট হয় না, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় স্বাস্থ্য-জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ও। এই তথ্য বিশ্বব্যাংকের।
এদিকে, শিগগিরই খুলে দেওয়া হবে দেশের প্রথম ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (উড়াল সড়ক)। দৃষ্টিনন্দন এ এক্সপ্রেসওয়ে খুলে দেওয়ার মধ্যদিয়ে রাজধানীবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হবে। অসহনীয় যানজট থেকে মুক্তি পাবে নগরবাসী।
জানা গেছে, নির্মাণাধীন এক্সপ্রেসওয়ের বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও অংশ (১২ কিলোমিটার) আগামী সেপ্টেম্বরে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মাত্র ১০ মিনিটে এক্সপ্রেসওয়েতে বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত ভ্রমণ করা যাবে। ঢাকার যানজট নিরসনে নেওয়া এই মেগা প্রকল্পের সংযোগ সড়কসহ দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। এক্সপ্রেসওয়েটিতে ১১টি টোল প্লাজা থাকছে। যার পাঁচটিই থাকবে এক্সপ্রেসওয়ের ওপরে। প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজার যানবাহন এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে চলাচল করবে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি ঢাকার উত্তর-দক্ষিণে বিকল্প সড়ক হিসেবে কাজ করবে। এতে ঢাকার সড়কে যানজট ও গাড়ির চাপ কমবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান সরকারের যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নয়নের আরেকটি মাইলফলক এই ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। রাজধানীর উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য উড়াল সড়কটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি নির্মাণ হলে মাত্র ২০ মিনিটে উত্তরা থেকে কুতুবখালী দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওঠা যাবে। প্রকল্পটি পুরোদমে চালু হলে বদলে যাবে রাজধানীর গণপরিবহণ ব্যবস্থা। এতে ঢাকা শহরের যানজট অনেকটা কমে যাবে এবং যাতায়াতে সময় ও খরচ কম লাগবে।
এদিকে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণ পাশ থেকে বনানী রেলস্টেশন পর্যন্ত ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটারের প্রথম অংশের কাজ শেষ পর্যায়ে। ইতোমধ্যে মূল কাজ শেষ হয়েছে। যার অগ্রগতি ৯৩ শতাংশ, এখন চলছে ফিনিশিংয়ের কাজ। সেইসঙ্গে শুরু হয়েছে সড়ক বাতি বসানোর কাজ। দুই পাশে রেলিং বসানোর কাজও চলছে। কয়েক দিনের মধ্যে কাওলা থেকে বনানী অংশ সম্পূর্ণ হবে। গাজীপুর থেকে কাওলা এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি উঠে যাবে, এরপর এই গাড়ি ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের কুতুবখালীতে গিয়ে নামবে। তাতে ঢাকা শহরের যানজট পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে এবং যানবাহনে চাপ অনেক কমে যাবে।
কাওলা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে। এতে ব্যয় হবে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থ ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগে (পিপিপি) তিন ধাপে উড়াল সড়ক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
উড়াল সড়কের রুট হচ্ছে- কাওলা, কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত। প্রায় পুরো পথই রেললাইন ঘেঁষে। এর প্রথম ধাপ হচ্ছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে বনানী রেলস্টেশন পর্যন্ত। দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে বনানী রেলস্টেশন থেকে মগবাজার রেলক্রসিং পর্যন্ত। তৃতীয় ধাপ হচ্ছে মগবাজার রেলক্রসিং থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত। প্রকল্প সম্পন্ন হলে রাজধানীকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের (কুতুবখালী) সঙ্গে যুক্ত করবে এক্সপ্রেসওয়েটি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প থেকে বিনিয়োগকারীরা তাদের অর্থ তুলবে চলাচলকারী যানবাহন থেকে টোল আদায়ের মাধ্যমে। এজন্য তারা টোল প্লাজা নির্মাণ করেছে। এই উড়াল সড়কে সর্বনিম্ন টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ টাকা। প্রাইভেট কার, জিপ, মাইক্রোবাস, ট্যাক্সির মতো হালকা শ্রেণির যানবাহনের জন টোলের এ হার নির্ধারণ করা হয়েছে। বাসের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ২০০ টাকা। অন্যদিকে সর্বোচ্চ ৬২৫ টাকা টোল ধরা হয়েছে বড় ট্রাকের জন্য। সড়কটিতে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতি নির্ধারণ করা হয়েছে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। মোটর সাইকেল ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মতো দুই ও তিন চাকার কোনো যানবাহন এই উড়াল সড়কে চলতে পারবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি বিমানবন্দর সংলগ্ন কাওলা এলাকায় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ পরিদর্শন শেষে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানান, নির্মাণাধীন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এয়ারপোর্ট থেকে তেজগাঁও অংশ সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন। বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার উড়াল সড়কে আসতে তাদের সময় লাগবে মাত্র ১০ মিনিট। তিনি জানান, প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। এতে উঠানামার জন্য ২৭ কিলোমিটারের ৩১টি র্যাম্প রয়েছে। এসব র্যাম্পসহ এক্সপ্রেসওয়টি প্রায় ৪৭ কিলোমিটার দীর্ঘ।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উড়াল সড়ক ২০১৪ সালে চালুর পরিকল্পনা ছিল। তবে নকশা ও ভূমি জটিলতায় কাজ পিছিয়ে যায়। ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর উড়াল সড়ক নির্মাণে বিনিয়োগকারী ইতাল-থাইয়ের সঙ্গে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকায় সংশোধিত চুক্তি করে সেতু বিভাগ। মূল অবকাঠামো নির্মাণে ইতাল-থাই ৬ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। এ জন্য চীনের দুই ব্যাংক থেকে ৮৬১ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। ভায়াবেলিটি গ্যাপ ফান্ডিং (ভিজিএফ) বাবদ সরকার দেবে ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। প্রথমে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তবে ঘোষণা ছিল ২০১৯ সালেই চালু হবে প্রকল্পটি। পরে আরও দুই দফা সময় বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে প্রকল্প মেয়াদ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাতিরঝিলে অংশে উড়াল সড়ক নির্মাণে রাজউকের আপত্তি রয়েছে। অন্য প্রকল্পের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি করতে পারে উড়াল সড়ক। এ রকম নানা জটিলতা রয়েছে এখনো। এরই মধ্যে প্রায় ১০ বছর সময় লাগছে। এতে অর্থব্যয়ও বেড়েছে এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা বেশি। ইতালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড, চায়না শানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপের (সিএসআই) এবং সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড উড়াল সড়ক নির্মাণে কাজ করছে।