সিদ্ধান্তহীনতায় পড়েছে দেশের আগামী একশ বছরের বন্দর হিসেবে গড়ে উঠতে যাওয়া চট্টগ্রাম বে –টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প । প্রকল্পের মাস্টার প্ল্যান নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা। বে–টার্মিনাল ২০১৭ সালের মাস্টার প্ল্যানে গড়ে তোলা হবে নাকি ২০২৩ সালের প্ল্যানে করা হবে তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে আগামী এক মাসের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। গত বুধবারও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সাথে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়েছে।

জানা যায়, নগরীর হালিশহর সমুদ্র উপকূলে জেগে ওঠা একটি চরকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট প্রাকৃতিক একটি চ্যানেল ব্যবহার করে গড়ে তোলা হচ্ছে বে– টার্মিনাল। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত মেগা প্রকল্পটি বেশ আগে গ্রহণ করা হলেও এটিতে গতি আসেনি। প্রকল্পটি জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পদে পদে নানা বাধা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। জেগে ওঠা চ্যানেলটিকে ঢেউ ও জোয়ারের স্রোত থেকে রক্ষা করতে নির্মাণ করতে হবে ব্রেক ওয়াটার। আবার চ্যানেলে বড় জাহাজ ভিড়ানোর জন্য বাড়াতে হবে গভীরতা। এ জন্য চ্যানেল খনন করতে হবে। উন্নয়ন করতে হবে ভূমির। শুরুতে ৯৩৯ একর ভূমিতে টার্মিনাল নির্মাণের কার্যক্রম শুরু করার কথা রয়েছে। ক্রমান্বয়ে এই বন্দরের এলাকা আড়াই হাজার একরে উন্নীত করা হবে। ছয় কিলোমিটারেরও বেশি লম্বা ভূমির উপর বে–টার্মিনাল গড়ে তোলা হচ্ছে। এই টার্মিনাল বাস্তবায়নে দুটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মাস্টার প্ল্যান তৈরিসহ আনুষাঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে কোরিয়ার কুনওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনসালটিং কোম্পানি লিমিটেড এবং ডিয়েনইয়াং ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড যৌথভাবে প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন, ইয়ার্ড নির্মাণ, জেটি নির্মাণসহ পুরো বন্দরের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। মোট ১২৬ কোটি ৪৯ লাখ ৭৩ হাজার ৯৮৬ টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠানটি বে–টার্মিনালের ডিজাইন, ড্রয়িং থেকে শুরু করে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অপরদিকে জার্মানির শেলহর্ন নামের অপর একটি কোম্পানি বে–টার্মিনালের ব্রেকওয়াটার নির্মাণ এবং চ্যানেল খননের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে।

এই দুটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গড়ে তোলা হবে বে– টার্মিনাল। দুটি প্রতিবেদনই গুরুত্বপূর্ণ। একটি রিপোর্টের সাথে অপর রিপোর্টের সমন্বয় করেই গড়ে তুলতে হবে বে–টার্মিনাল। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দুটির রিপোর্ট চূড়ান্ত করার আগে বেশ কিছু বিষয় সুরাহা করা জরুরি হয়ে উঠেছে। ছয় কিলোমিটারেরও বেশি লম্বা জায়গার ঠিক কোত্থেকে বে–টার্মিনাল শুরু করা হবে তা নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ২০১৭ সালে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, বে–টার্মিনাল গড়ে তোলা হবে বিশাল জায়গাটির মাঝখানে। দুই পাশে জায়গা রেখে মাঝখানে জেটি এবং ইয়ার্ডসহ বন্দরের নানা সুবিধা গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে দুই পাশে ক্রমান্বয়ে উন্নয়ন করা হবে। এই পরিকল্পনা নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ অগ্রসর হলেও বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মাঝখানে না করে এক পাশ থেকে করলে প্রকল্পের খরচ কমে যাবে। এতে বন্দর লাভবান হবে। বিশ্বব্যাংকের এই প্রস্তাবনার পর বিষয়টি নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সাথে বিষয়টি নিয়ে আবারো আলোচনা করা হয়।

সূত্র বলেছে, মাঝখানে বন্দর গড়ে তুললে শুরুতে কিছু বাড়তি খরচ পড়লেও ভবিষ্যতে বন্দর উন্নয়নে খরচ কমে যাবে। অর্থাৎ শুরুতে বে– টার্মিনালের জন্য নির্দিষ্ট ভূমির মাঝখানে বন্দর নির্মাণ করে পরবর্তীতে দুদিকে বন্দরের নানা অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হবে। অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ হচ্ছে, শুরুতে একপাশে বন্দর নির্মাণ করে কার্যক্রম শুরু করা এবং পরবর্তীতে ধাপে ধাপে বন্দরের উন্নয়ন করলে খরচ কম পড়বে।

বিষয়টি নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সাথে নতুন করে আলোচনা করেছে। বিষয়টির উপর সমীক্ষা করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রিপোর্ট প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে তাগাদা দেয়া হয়েছে। বন্দর অবকাঠামো গড়ে তোলার স্থান নিয়ে নতুন এই প্রশ্নটি বড় কোনো সংকট সৃষ্টি করবে না বলে মন্তব্য করে বন্দরের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এটি কোনো জটিলতা নয়, স্থান নির্ধারণ নিয়ে কিছুটা চিন্তাভাবনা। দ্রুতই ব্যাপারটি নিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করা হবে।

সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেছেন, বন্দর কর্তৃপক্ষের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বে–টার্মিনাল নিয়ে তৎপরতা শুরু করেন। এতে দীর্ঘদিন ধরে থমকে থাকা প্রকল্পটি নতুন করে গতি লাভ করে। কিন্তু পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট যথাযথভাবে না পাওয়ায় প্রকল্পের কার্যক্রম নিয়ে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। এই অবস্থায় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সাথে জরুরি বৈঠক করেছেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান। তিনি দ্রুততম সময়ের মধ্যে রিপোর্ট প্রদানের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা প্রদান করেছেন। গত বুধবারও শেলহর্ন জার্মানির সাথে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে তিনি আগামী এক মাসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলেছেন। এই রিপোর্ট পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও সূত্র জানিয়েছে।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম চলে সাড়ে চারশ’ একর ভূমিতে। এতে করে বে–টার্মিনাল চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে পাঁচ গুনেরও বেশি বড় এলাকায় পরিচালিত হবে। চট্টগ্রাম বন্দরে সর্বোচ্চ সাড়ে নয় মিটারে ড্রাফটের জাহাজ বার্থিং নিতে পারে। বে–টার্মিনালে ১৪ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে। বে–টার্মিনালে মোট তিনটি টার্মিনাল থাকবে। প্রতিটি টার্মিনালে ৩০০ মিটার লম্বা ছয়টি জেটি থাকবে। অর্থাৎ একটি টার্মিনালে ১৮শ’ মিটার লম্বা জেটি এবং পশ্চাদসুবিধা গড়ে তোলা হবে। প্রতিটি টার্মিনালে একই সাথে ছয়টি জাহাজ বার্থিং দেয়া যাবে। প্রকল্প গ্রহণের শুরুতে বে–টার্মিনালে ২০২৪ সালে জাহাজ ভিড়ানোর আশাবাদ ব্যক্ত করা হলেও নানা জটিলতায় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত মেগাপ্রকল্পটি বেশ পিছিয়ে রয়েছে।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031