বিএনপি সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে জুলাই থেকে এক দফা আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। এ ক্ষেত্রে দাবি মানাতে গিয়ে ২০১৪ সালের মতো সহিংসতায় জড়িয়ে পড়তে পারে দলটি এমন অভিযোগ উঠেছে।
অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে রাজপথে উত্তাপ ছড়ানোর হুংকার দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। এছাড়া গতানুগতিক ধারায় সরকারের মেয়াদের শেষ সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনের রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অঙ্গনের সব ধরনের নৈরাজ্য ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘লাস্ট সিক্স মানথস স্ট্র্যাটিজিক প্ল্যান’ (শেষ ষান্মাসিক কৌশলী পরিকল্পনা) তৈরি করেছে।
আগামী মাসের শুরুতেই এ ‘ছক’ জেলা পুলিশ সুপারদের (এসপি) হাতে পৌঁছে যাবে। তারা তা থানা পুলিশকে অবহিত করবেন। একই সময় মেট্রোপলিটন কমিশনারদের মাধ্যমে প্রতিটি মহানগরের আওতাভুক্ত থানাগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হবে।
এই পরিকল্পনায় গতানুগতিক ফৌজদারি মামলার তদন্ত, আসামি ধরপাকড় ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য রুটিন ওয়ার্ক স্বাভাবিকভাবে পরিচালনার পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনে উদ্ভূত যে কোনো নৈরাজ্য কীভাবে তাৎক্ষণিক সামাল দেওয়া যায় তার সুবিন্যস্ত ছক রয়েছে। অনাকাক্সিক্ষত কোনো ঘটনা সংঘটিত হওয়ার আগেই কোন কৌশলে কীভাবে তা দ্রুত প্রতিরোধ করা সম্ভব তার গাইড লাইনও দেওয়া আছে।
অন্যদিকে রাজনৈতিক আন্দোলনের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে পুলিশের কোনো কর্মকর্তা কিংবা সদস্য যাতে কোনো ধরনের কোনো উসকানির ফাঁদে পা না দেন, সে ব্যাপারেও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। অতি উৎসাহী পুলিশ সদস্যদের দিকে তীক্ষè নজর রাখার পাশাপাশি পুলিশের নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিতেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার জন্য ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাদের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশের ডিআইজি পদমযার্দার একজন কর্মকর্তা জানান, নির্বাচনের আগের শেষ তিন মাস সব সময়ই ‘স্পশর্কাতর’। তবে এবার দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনেকটাই ভিন্ন। এবার কিছুটা আগেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি আকস্মিক যে কোনো দিকে মোড় নিতে পারে। রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে রাজপথে নানা নৈরাজ্যকর ঘটনা ঘটতে পারে। সরকার ও বিরোধী দলের মুখোমুখি অবস্থানে নানা ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি ভয়াবহ সংঘাত-সহিংসতায় রূপ নেওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। অতীতে একাধিকবার জাতীয় নির্বাচনের আগে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি শত শত নিরীহ মানুষ জ্বালা-পোড়াও ও বোমাবাজিসহ নানা রাজনৈতিক সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংঘটিত নৈরাজ্য অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। তাই এসব বিষয় বিবেচনায় সবদিক সামাল দিতে এবার আগেভাগেই কৌশলী পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে।
পুলিশের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দাবি, যথাসময়ে এ কৌশলী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে নির্বাচনের আগে-পরে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা দেশে বড় ধরনের কোনো তাণ্ডব সৃষ্টির সুযোগ পাবে না। সন্ত্রাসী কোনো গোষ্ঠী বিশেষ কোনো মিশন সফল করার অপচেষ্টা চালালে তা ব্যর্থ হবে। এতে দেশের মানুষ নির্বিঘ্নে নিজের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পারবে। এছাড়াও সরকারের পটপরিবর্তনের শেষ সময়ে নানা অজানা আতঙ্কে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যে স্থবিরতা তৈরি হয়- সে সংকটও কাটবে। তবে রাজনৈতিক কোনো বিষয়ে পুলিশ সরাসরি হস্তক্ষেপ করবে না বলে দাবি করেন তিনি।
পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনের আগে স্পশর্কাতর শেষ ছয় মাস, দেশের প্রতিটি থানার ফুট ও কার পেট্রোল দ্বিগুণ করা হবে। এ সময় সংশ্লিষ্ট জোনের সহকারী কমিশনার (এএসপি) থেকে আপ-ওয়ার্ড প্রতিটি কর্মকর্তা এ টহল কার্যক্রম নিয়মিত মনিটর করবেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে গোয়েন্দা নজরদারি কয়েকগুণ বাড়ানো হবে। বিভিন্ন সময়ের আন্দোলন কর্মসূচিতে যারা বোমাবাজি, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরসহ নানা ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিল তাদের গতিবিধি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখবে পুলিশ। যাতে পলিটিক্যাল ক্যাডার কিংবা ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা তাদের সঙ্গে নিয়ে কোনো ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা চালালেই তাদেরকে আইনের আওতায় এনে সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যায়।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন পূর্ববর্তী ষান্মাসিক কৌশলী পরিকল্পনা অনুযায়ী, এ সময়টুকু আইনশৃঙ্খলা রক্ষার রুটিন ওয়ার্কের পাশাপাশি রাজনৈতিক নানা ইস্যু পর্যবেক্ষণে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। কোনো আন্দোলন কর্মসূচিতে বিশৃঙ্খলা কিংবা নৈরাজ্য সৃষ্টির আশঙ্কা থাকলে তা মোকাবিলায় পুলিশকে আগাম প্রস্তুতি রাখার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বিগত সময়ের মতো বিদেশে আত্মগোপনে থাকা আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডনরা যাতে রাজনৈতিক অঙ্গনে পা রেখে দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তুলতে না পারে, সেজন্য তাদের গতিবিধিও পর্যবেক্ষণে রাখবে গোয়েন্দারা। পাশাপাশি কারাবন্দি টপ টেরররা যাতে এ সময় জামিনে মুক্তি না পায়, আইনগত সে তৎপরতা অব্যাহত রাখতেও লাস্ট সিক্স মানথস স্ট্র্যাটিজিক প্ল্যানে নির্দেশ দেওয়া আছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বরাবরই রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সে বিষয় বিবেচনায় রেখেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ছক তৈরি করা হয়। তবে এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। তাই পুলিশের পরিকল্পনাতেও বিশেষ কৌশল যোগ করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা জোনের আওতাধীন একটি থানার একজন ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) জানান, নির্বাচন পূর্ববর্তী কৌশলী পরিকল্পনা সম্পর্কে লিখিত আদেশ না পেলেও এরই মধ্যে তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে মৌখিক নির্দেশনা পেয়েছেন। সে অনুযায়ী তারা আগামী দিনের ডিউটি চার্ট ও আনুষঙ্গিক কার্যক্রমের ছক তৈরি করছেন। যাতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পাওয়ার পর দ্রুত তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া যায়।
মিরপুর জোনের একটি থানার ওসি জানান, ঈদুল আজহার পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে সম্প্রতি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাদেরকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া স্থানীয় অস্ত্রধারী পলিটিক্যাল ক্যাডার, বোমাবাজ, অগ্নিসংযোগকারী ও ভাড়াটে নাশকতাকারীদের আপডেট তালিকা চাওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে থানায় দায়েরকৃত নাশকতার পুরনো মামলার বর্তমান অবস্থা এবং এর আসামিদের অবস্থান সম্পর্কেও সর্বশেষ তথ্য চাওয়া হয়েছে।
এদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচন ঘিরে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। সামনে এই উত্তাপ আরও বাড়বে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ বাহিনীও প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর অংশ হিসেবে শটগান, কার্তুজ, সাউন্ড গ্রেনেড, কালার স্মোক গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেলসহ অনেক সরঞ্জাম আমদানি করা হচ্ছে। কিছু ইতিমধ্যে দেশে এসেছে। সবশেষ চারটি পৃথক দরপত্রে প্রায় ৩০ কোটি টাকার ২ লাখ ৩৪ হাজার ৮০০ কাঁদানে গ্যাসের শেল এবং সাউন্ড গ্রেনেড আমদানির ব্যাপারে অনাপত্তি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর একটিতে ১ কোটি ৯২ লাখ ৫৬ হাজার টাকায় ১০ হাজার কালার স্মোক গ্রেনেড এবং আরেকটিতে ৫ কোটি ১৮ লাখ ৯৪ হাজার টাকায় ২০ শতাংশ ভেরিয়েশনের ২৮ হাজার ৫০০ সাউন্ড গ্রেনেড কেনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অপর দু’টি অনাপত্তিপত্রে ১ লাখ ৯৬ হাজার কাঁদানে গ্যাসের শেল কেনার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এর একটিতে রয়েছে ১২ কোটি ৪৭ লাখ ৬২ হাজার টাকায় ১ লাখ ১০ হাজার কাঁদানে গ্যাসের শেল। অন্যটিতে ১০ কোটি ৪৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকায় ৮৬ হাজার কাঁদানে গ্যাসের শেল কেনার কথা উল্লেখ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের জন্য এসব উপকরণ কেনা হচ্ছে। যদিও পুলিশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা এটিকে রুটিন কেনাকাটা বলে দাবি করেন।
এ প্রসঙ্গে সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘কয়েক মাস পরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ সময় অনেকে রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা করে। এ জন্য পুলিশ আগাম প্রস্তুতি এবং কৌশলী পরিকল্পনা গ্রহণ করে।’তখন তাদেরকে আত্মরক্ষার পাশাপাশি জনগণের জানমাল সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হয়।