চারপাশে ঘিরে থাকা স্বজনরা মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছিল। বার বার মূর্ছা যাচ্ছিল আরতি দাশ। একটু হুঁশ ফিরলেও কথা বলতে পারছিল না। শুধু দুই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। ঘরের এক কোণে বিমর্ষ ও বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছেন তার স্বামী মিঠুন দাশ। তাকেও ঘিরে আছেন প্রতিবেশিরা। দিচ্ছিলেন সান্তনা। সেই সব প্রতিবেশির চোখেও জল।

গত রাত সোয়া ১১টায় এ দৃশ্য দেখা গেছে নগরের কোতোয়ালী থানার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আান্দরকিল্লা ওয়ার্ডের বাণ্ডেল রোডের সেবক কলোনিতে। আগুনে দগ্ধ হয়ে ১৮ দিনের ব্যবধানে মারা গেছে চসিকের সেবক মিঠুন–আরতি দম্পতির তিন মেয়ে। সর্বশেষ গতকাল দুপুরে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তৃতীয় সন্তান তৃতীয় মেয়ে হ্যাপি দাস (৬)। এর আগে হ্যাপির মৃত্যুর সংবাদ সেবক কলোনিতে পৌঁছানোর পর থেকেই পুরো এলাকায় নেমে আসে শোক। প্রায় সময় আনন্দ উচ্ছ্বাসে মেতে থাকা এ কলোনির সেবকরা ভেঙে পড়েন। পুরো এলাকায় নেমে আসে নিরবতা। গত রাত ১১টা ৭ মিনিটে আসা হ্যাপির শববাহী অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন সে নিরবতায় যেন তুলছিল বেদনার সুর।

স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, গত ২০ জুন নিজ ঘরে অগ্নিদগ্ধ হন আরতি–মিঠুন দম্পতির চার মেয়ে সারথী রাণী দাশ (১৭), সাখশী রাণী দাশ (১৩), হ্যাপি রাণী দাশ (৬) ও আড়াই বছর বয়সী সুইটি রাণী দাশ। এর মধ্যে ২৪ জুন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাপসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সাখশী। ৩০ জুন সারথী এবং গতকাল মারা যায় হ্যাপি। কিছুটা কম দগ্ধ হওয়া সুইটি প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়ার পর সুস্থ হয়ে উঠে। সে কানের পাশে সামান্য আঘাত পায়। সারথী, সাখশী ও হ্যাপির শরীরের ৯০ থেকে ৯৭ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। সারথী পাথরঘাটা মেনকা সিটি করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণি, সাখশী মিউনিসিপ্যাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণি এবং হ্যাপি স্থানীয় সানরাইজ গ্রামার স্কুলের কেজি শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন।

জানা গেছে, ঘটনার দিন সকালে চার মেয়েকে বাসায় রেখে কাজে যান মিঠুন ও আরতি। এসময় প্রতিবেশিরা বিকট শব্দ শুনে ছুটে গিয়ে দেখতে পান এ দম্পত্তির চার মেয়ে দগ্ধ হন। ওই বাসাটির চালের সঙ্গে তাপ প্রতিরোধক রেঙিন রয়েছে। আগুন লাগার পর তা তাদের শরীরের ওপর পড়তে থাকে। এ সময় তাদের চিৎকারের শব্দ শুনে স্থানীয় লোকজন গিয়ে দরজা ভেঙ্গে তাদের উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ২২ জুন সারথী ও হ্যাপিকে ঢাকায় পাঠানো হয়। ঘটনার পর থেকে অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল সাখশীর। তাই তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সে।

মারা যাওয়া তিন বোনের মামা উত্তম দাশ আজাদীকে বলেন, তিন ভাগ্নীকে বাঁচানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। ঢাকা–চট্টগ্রাম দৌঁড়াদৌড়ি করেও তাদের বাঁচাতে পারিনি। তাদের হারিয়ে আমরা নাওয়া–খাওয়া ভুলে গেছি। তাদের মা–বাবা কথা বলার অবস্থায় নেই। তিনি বলেন, সাখশী মারা যাওয়ার সময় তার মা ঢাকায় ছিল। সৎকারের আগে মেয়েকে শেষবার দেখার জন্য তাকে মিথ্য বলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আনা হয়। পরে তিনি ঢাকায় ফিরে গিয়ে দুই মেয়ের সেবা করে। কিন্তু মেয়েকে বাঁচাতে পারেনি।

ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তম বলেন, ঘটনার দিন আগুন লাগার খবর পেয়ে ছুটে আসি। এসে দোখ সবাই তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল। পড়ে জানতে পারি, সাখশী সকালে গ্যাসের চুলায় দুধ গরম করে সুইটিকে খাওয়াতে খাওয়াতে তার পাশে ঘুমিয়ে পড়েন। সম্ভবত গ্যাসের চুলা থেকেই এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

কোতোয়ালী থানার তদন্ত কর্মকর্তা উপ–পরিদর্শক (এসআই) শামসুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, দুধের পাতিল চুলা থেকে নামিয়ে রাখলেও চুলার সুইচ বন্ধ করার কথা মনে ছিল না সাখশীর। ঘণ্টাখানেক পর সারথী ঘুম থেকে উঠে দ্রুত ছোট বোনের জন্য দুধ গরম করতে যান। তিনি দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে পুরো ঘরে আগুন ধরে যায়। তখন সুইটিকে বাঁচাতে তিন বোন তার শরীরের ওপর উপুড় হয়ে থাকেন।

বাণ্ডেল সেবক কলোনির সভাপতি ঝর্ণা দাশ বলেন, ঘটনার আগের রাতে মিঠুন মোহসেন আউলিয়া যায়। আরতি সকালে চাকরির ফিঙ্গার দেয়ার জন্য যায়। এ সময় ঘরে চার সন্তানকে রেখে যায়। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে সবাই দরজা ভেঙে দেখে চার মেয়ে দগ্ধ। পরে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়। তিনি বলেন, শুধু মেয়েরা পুড়েছে। ঘর একটুও পুড়ে যায়নি। গ্যাস, চুলা সব ঠিক আছে।

তবে মারা যাওয়া তিন বোনের মামা উত্তম দাশ আজাদীকে বলেন, চালের সঙ্গে থাকা রেঙিন পুড়ে গেছে। ঘরের অনেক কিছু নষ্ট হয়েছে। সেগুলো আমরা পরে ঠিক করি।

হ্যাপির লাশ নিয়ে আসা তার কাকা অনিকেষ দাশ বলেন, মঙ্গলবার রাতে হ্যাপির সাথে সর্বশেষ কথা হয়। আইসিউতে কাউকে যেতে দিত না। এক সিকিউরিটিকে বলে গিয়েছিলাম। সে কথা বলে এবং জুস ও বিরিয়ানি খেতে চায়। বমি হওয়ার কারণে ডাক্তার বিরিয়ানি দিতে মানা করলে শুধু জুস কিনে একটু খাওয়াতে পেরেছি। মারা যাওয়ায় তাকে আর বিরিয়ানি খাওয়াতে পারলাম না।

এদিকে গতকাল বিকেলে ওই সেবক কলোনিতে উপস্থিত হয়ে দেখা গেছে, পুরো কলোনিজুড়েই নিরবতা। মিঠুন–আরতির বাসার সামনে জড়ো হযেছিলেন তাদের প্রতিবেশি ও স্বজনরা। মিঠুনের মা মালা রানী দাশ তিন নাতনীকে হারিয়ে বিলাপ করছিলেন।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031