পটুয়াখালীর পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন কয়লার সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে । এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিটের মধ্যে একটি ইউনিট গত ২৫ মে বন্ধ হয়। অপরটি আজ দুপুর ১২টার দিকে বন্ধ হয়ে যায়। আগামী ২০-২৫ দিন এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ থাকতে পারে বলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শাহ আব্দুল হাসিব জানিয়েছেন।

সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা বন্ধ হচ্ছে বলে গত কয়েকদিন ধরে গোটা দেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। পায়রা বন্ধ হওয়ার আগে থেকেই লোডশেডিং ভোগান্তিতে রয়েছে মানুষ। এর ওপর পায়রা বন্ধ হওয়ার খবরে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।

এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হওয়ায় দেশের চলমান লোডশেডিং পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। খোদ রাজধানীতেই দফায় দফায় লোডশেডিং হচ্ছে।

এছাড়া সমগ্র বরিশাল, খুলনা ও ঢাকার বেশ কিছু অংশের বিদ্যুতের নির্ভরযোগ্য উৎস ছিল এই কেন্দ্রটি। ফলে দেশজুড়ে জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড দাবদাহে বিদ্যুতের যাওয়া-আসা মানুষের জীবনযাপনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।

দেশে এখন বিদ্যুতের সর্বোচ্চ দৈনিক চাহিদা প্রায় ১৭ হাজার মেগাওয়াট। তবে প্রতিদিন সরবরাহ হচ্ছে ১২ থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ১০ ভাগই এককভাবে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আসে। প্রতিদিন এ কেন্দ্রের দুটি ইউনিট থেকে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হত। কেন্দ্রটি পুরোদমে চালাতে প্রতিদিন কয়লার ১২ হাজার টন প্রয়োজন। গত মে মাসের শেষদিকে কয়লা সংকটে একটি ইউনিট বন্ধ করে দেওয়া হয়। অন্য ইউনিটটিরও উৎপাদন কমানো হয়। এখন সেই ইউনিটটিও গতকাল বন্ধ হয়ে গেল।

পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিট জ্বালানি ব্যয় ৫ টাকা ৫০ পয়সা। অন্যদিকে ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্রের ব্যয় ইউনিটপ্রতি ৩০ টাকার বেশি আর ফারনেসের উৎপাদন ব্যয় ১৪ টাকার কিছু বেশি। এ পরিস্থিতিতে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশি চালালে সরকারকে প্রতিদিন অন্তত বাড়তি গুনতে হবে ১৫০ কোটি টাকা। কয়লা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে না আসা পর্যন্ত দেশের বিদ্যুতের পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। কয়লা আসতে সময় নেবে ২৫ জুন পর্যন্ত। এ পর্যন্ত থাকবে লোডশেডিং।

২০২০ সালের ১৫ মে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রথম ইউনিটটি উৎপাদন শুরু করে। ওই বছরের ডিসেম্বরে উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করে প্লান্টটির দ্বিতীয় ইউনিট। তবে এটি ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন করলেও দীর্ঘ সময় একটি ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ থাকে। কেননা, এ সময়কালে সঞ্চালন লাইনের নির্মাণকাজ চলমান ছিল।

এর আগে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তবে উৎপাদনে যাওয়ার পর এবারই প্রথমবারের মতো কয়লা সংকটে পুরোপুরি বন্ধ হলো বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।

ডলার সংকটে এপ্রিলে কোনো এলসি খুলতে না পারায় মে মাসে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য কোনো কয়লা আসেনি। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের খামখেয়ালিকে দায়ী করেছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা।

বিদ্যুৎ বিভাগের অভিযোগ, কেন্দ্রটির কয়লা আমদানির জন্য ডলার চেয়ে বারবার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে তারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, চীন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য আর কয়লা আমদানি করে দিতে না চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের সংস্থান করে দিতে সম্মত হয়। ততক্ষণে কেন্দ্রটির জন্য কয়লা ফুরিয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সংকট মেটানোর বিষয়টিতে আগে গুরুত্ব দিলে পয়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হতো না।

বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বর্তমান পাওনা প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। ডলার সংকট থাকায় এলসি খোলা যাচ্ছিল না। আর এ কারণে কয়লা আমদানি সম্ভব হচ্ছে না। কয়লার অভাবে তাই বন্ধ হয়ে গেল বিদ্যুৎ উৎপাদন।

পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সূত্র বলছে, কেন্দ্রটির কয়লা আমদানি করে চীনা অংশীদার প্রতিষ্ঠান সিএমসি। ছয় মাসের বিলম্বিত পরিশোধ ঋণপত্রের সুবিধায় সিএমসি পায়রাকে কয়লা এনে দেয়। কিন্তু সিএমসির ছয় মাসের দেনা নয় মাসেও শোধ করতে পারেনি পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এতে শুধু কয়লার দাম ৩০০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া পড়ে। এর প্রেক্ষিতে চীনা বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরপরই বাংলাদেশ ব্যাংক নড়েচড়ে বসে। তারা কেন্দ্রটির বকেয়া ৩০০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১০০ মিলিয়ন ডলার দিতে সম্মত হয়।

তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শাহ আব্দুল হাসিব বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার ১০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। এতে নতুন করে কয়লা সরবরাহ শুরু হবে। তবে কয়লা আসতে অন্তত ২০-২৫ দিন সময় লাগবে। এ সময় বন্ধ থাকবে কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ উৎপাদন। এরপর কয়লা এলে জুনের শেষ সপ্তাহে আবারও উৎপাদন শুরু হবে।’

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশ-চীন পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসি) পটুয়াখালীর পায়রায় ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লা-তাপভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি) সমান মালিকানা রয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে।

পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহ করে ইন্দোনেশিয়ার যে কোম্পানি, সেই কোম্পানির দাম পরিশোধ করে সিএমসি। বিসিপিসিএলের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, কয়লা আমদানিসংক্রান্ত চুক্তি অনুযায়ী সিএমসি কয়লা ক্রয়ের ছয় মাস পরে বাংলাদেশ অর্থ পরিশোধ করতে পারবে। তিনি বলেন, ‘ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রোভাইড করে সিএমসি। ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হলো- আমরা ইন্দোনেশিয়া থেকে যে কয়লা কিনি, তার ইনভয়েসের এগেইনস্টে সিএমসি এলসি করে পেমেন্ট করে। চুক্তি অনুযায়ী, আমাদের পেমেন্ট মেথড হলো ডেফার্ড পেমেন্ট (দেরিতে পরিশোধ)। শর্তানুযায়ী, আমরা ছয় মাস পর সিএমসিকে বিল দেই। অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে ইন্দোনেশিয়ার কৌল-মাইনিং কোম্পানিকে সিএমসি যে পেমেন্ট দেবে, আমরা জুলাইয়ে সিএমসিকে তা পরিশোধ করব। বাস্তবতা হচ্ছে, ছয় মাস তো পার হয়ে গেছে অনেক আগেই। আরও পাঁচ মাস চলে গেছে। আমরা বকেয়া শোধ করতে পারছি না।’

এত টাকা বকেয়া হওয়ায় চীনের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ কয়লা ক্রয়ে নতুন করে এলসি খুলতে সিএমসিকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

বিদ্যুৎ খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করে কয়লা আমদানি অব্যহত রাখা জরুরি। কারণ, কয়লা সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলে সামনের দিনগুলোতে বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো অসম্ভব হয় পড়বে। ফলে একদিকে সাধারণ মানুষ লোডশেডিংয়ের ভোগান্তিতে পড়বে; অন্যদিকে শিল্পোৎপাদনেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031