কোটি কোটি ডলার পাচার করা হচ্ছে ডলার সংকটের মাঝে পুরনো ইঞ্জিন আমদানির আড়ালে । ঢাকা ও চট্টগ্রামে গড়ে ওঠা সংঘবদ্ধ একটি চক্র পুরনো গাড়ির ইঞ্জিন আমদানির আড়ালে হুন্ডির মাধ্যমে পার করছে এই অর্থ। ব্যাপক হারে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য এনে সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ও শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছে। ফোর সিলিন্ডার ইঞ্জিনের ঘোষণা দিয়ে আনা হচ্ছে এইট সিলিন্ডার ইঞ্জিন। আবার পেট্রোল ইঞ্জিন ঘোষণা দিয়ে আনা হচ্ছে ডিজেল ইঞ্জিন।
ইঞ্জিনসহ কেবিন, পুরনো টায়ার, পুরনো ব্যাটারিসহ বিভিন্ন আইটেম আমদানি নিষিদ্ধ হলেও চক্রটি অবাধে এসব পণ্য নিয়ে আসছে। মিথ্যা ঘোষণায় আনা চট্টগ্রামের একাধিক আমদানিকারকের ২৫টি কন্টেনার পণ্য বন্দরে আটকা পড়ে আছে। গোয়েন্দা তৎপরতায় চট্টগ্রামে কড়াকড়ি শুরু হওয়ায় চক্রটি পানগাঁও ও কমলাপুর আইসিডি দিয়ে পণ্য খালাস করছে। গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বছরে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার শুল্ক ও রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার পাশাপাশি নানাভাবে দেশের ক্ষতি করা হচ্ছে। চক্রটির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, অনেক বছর ধরে দেশে পুরনো ইঞ্জিন আমদানি হয়ে আসছে। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু হওয়া এই ব্যবসার প্রসার দিনে দিনে বেড়েছে। একসময় আমদানিকৃত পুরাতন ইঞ্জিন শুধু গাড়িতে ব্যবহার করা হলেও কয়েক বছর ধরে ইঞ্জিন ব্যবহারের ক্ষেত্র বেড়েছে। এখন গাড়ি ছাড়াও নৌকা, পাথর ভাঙার মেশিনসহ বিভিন্ন ইকুইপমেন্টে গাড়ির পুরনো ইঞ্জিন ব্যবহার করা হচ্ছে। আগে পুরো বছরে ১০ থেকে ১৫ হাজার পিস ইঞ্জিন আমদানি হলেও এখন তা বিশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু সংঘবদ্ধ একটি চক্র ইঞ্জিন আমদানির আড়ালে পুরো গাড়ি কেটে নিয়ে আসছে। দুবাই, মালয়েশিয়া, জাপান ও চীন থেকে কন্টেনার ভর্তি করে আনা হচ্ছে কোটি কোটি টাকার পণ্য। চীন থেকে পুরনো ইঞ্জিন আমদানির বৈধ সুযোগ না থাকলেও সংঘবদ্ধ চক্রটি নানা গোঁজামিল দিয়ে নিষিদ্ধ পণ্যগুলো আমদানি করে। এসব পণ্যের মূল্য হুন্ডির মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়।
জানা যায়, পুরনো ইঞ্জিনসহ মোট ৩৭টি আইটেম আমদানি করার অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একটি গাড়ির সাথে থাকা শতাধিক আইটেম চক্রটি দেশে নিয়ে আসে। এর মধ্যে গাড়ির কেবিনসহ ইঞ্জিন, পুরনো টায়ার, পুরনো ব্যাটারি, পুরনো চেসিস আমদানি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু এসব পণ্য প্রায় আনা হচ্ছে। পুরো গাড়িকে কয়েক টুকরো করে কেটে কন্টেনারে ভরে আনা হচ্ছে। এসব গাড়ি এখানে এনে জোড়া দিয়ে চালানো হচ্ছে রাস্তায়। দুর্ঘটনায় নষ্ট হওয়া কিংবা পুরনো গাড়ির কাগজপত্র ব্যবহার করে এসব অবৈধ গাড়ি রাস্তায় চলছে। চক্রটির এই তৎপরতায় সরকার দুইভাবে রাজস্ব হারাচ্ছে। গাড়ি আমদানির শুল্কের পাশাপাশি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন খাতের শুল্কও হারাচ্ছে।
সংঘবদ্ধ চক্রটি চট্টগ্রামে আস্তানা গড়ে তুলেছে উল্লেখ করে সূত্র জানায়, প্রকৃতপক্ষে দেশে দুইভাবে পুরনো ইঞ্জিন আমদানি হয়। কিছু ব্যবসায়ী কমার্শিয়াল আইআরসির বিপরীতে ইঞ্জিন আমদানি করেন। আবার অনেকে নিজেদের গ্যারেজে ব্যবহারের কথা বলে গ্যারেজ লাইসেন্সে ইঞ্জিন আমদানি করেন। দেশে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মিলে শখানেক গ্যারেজ লাইসেন্স রয়েছে। এসব লাইসেন্সের একটিরও কোনো গ্যারেজ নেই। এরা যেসব ঠিকানা দিয়ে লাইসেন্স নিয়েছেন তার শতভাগ ভুয়া। ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা খরচ করে একেকটি গ্যারেজ লাইসেন্স নিয়ে চক্রটি কোটি কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য শুরু করে।
চট্টগ্রামের মুরাদপুর, পোড়া মসজিদ ও কদমতলী এলাকায় শত কোটি টাকার অবৈধ ব্যবসা চলে উল্লেখ করে গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, মুরাদপুরের মোবারক হোসেন, জসিম উদ্দীন, তার ভাই আবু তাহের, জয়নাল, মনির হোসেন, জুয়েল, আলতাফ হোসেন, শহীদ ও তাজুল ইসলাম, পোড়া মসজিদ এলাকার আলাউদ্দিন, আমিন জুট মিল এলাকার আহমেদ রশিদ, চান্দগাঁওয়ের ইকবাল হোসেন, মোরশেদুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন আমদানিকারক ব্যবসাটি নিয়ন্ত্রণ করেন।
এদের প্রত্যেকের দোকান ও ডিপোতে কোটি কোটি টাকার আমদানি নিষিদ্ধ মোটর পার্টস রয়েছে। কাস্টমস ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে ম্যানেজ করে চক্রটি বছরের পর বছর ধরে এভাবে কালো টাকার পাহাড় গড়ছে। এদের প্রত্যেকেরই দেশে–বিদেশে বাড়িসহ বিভিন্ন বিনিয়োগ রয়েছে। এদের মধ্যে জসিম উদ্দিনের সংযুক্ত আরব আমিরাতের আজমানে বাড়ি ও মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম রয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সূত্র বলেছে, দেশে কার, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, জিপসহ বিভিন্ন গাড়ির ইঞ্জিন আমদানি করা হয়। পুরাতন গাড়ির ইঞ্জিনের মধ্যে চার সিলিন্ডার, ছয় সিলিন্ডার, আট সিলিন্ডার ও সর্বোচ্চ দশ সিলিন্ডারের ইঞ্জিন আমদানি করা হয়। ইঞ্জিনের শুল্ক আদায় করা হয় সিলিন্ডারের ওপর। ইঞ্জিনের সিলিন্ডার বাড়ার সাথে সাথে শুল্কের পরিমাণও বাড়তে থাকে। কিন্তু এখানে গোঁজামিল দিয়ে পণ্য খালাস করা হয়। প্রকৃতপক্ষে ৮ সিলিন্ডারের এফটুওয়ানসি ইঞ্জিন ২০ হাজার ৭৮০ সিসি। কিন্তু এগুলোকে ৪ বা ৬ সিলিন্ডারের ১০ হাজার সিসির কম ঘোষণা দিয়ে শুল্ক ফাঁকি দেয়া হচ্ছে। ইঞ্জিনের উপর সিসি উল্লেখ না থাকার সুযোগ নিয়ে চক্রটি নিজেদের মতো করে কাগজপত্র তৈরি করে।
অপরদিকে ওজননীতির মাধ্যমেও পণ্য খালাস করা হয়। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওজনের উপর শুল্ক নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে দশ টনের পণ্যকে এক টন ঘোষণা দিয়ে পার করে নেয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য খালাসের ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এতে কয়েকজন আমদানিকারকের অন্তত ২৫ কন্টেনার পুরনো ইঞ্জিন আটকা পড়েছে। ইঞ্জিন ঘোষণা দিয়ে আমদানি নিষিদ্ধ আইটেম নিয়ে আসায় কাস্টমস এগুলো আটক করেছে। গোয়েন্দা তৎপরতার প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামে ব্যাপক কড়াকড়ি শুরু হলে চক্রটি ঘুরপথ ধরে চট্টগ্রামে কন্টেনার নিয়ে আসছে। দুবাই কিংবা মালয়েশিয়া থেকে আনা কন্টেনার চক্রটি চট্টগ্রাম থেকে প্রথমে কমলাপুর আইসিডি এবং পানগাঁও টার্মিনালে নিয়ে খালাস করছে। ওখান থেকে চট্টগ্রামে এনে বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করে। গোয়েন্দা সূত্র দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে বলেছে, চট্টগ্রামে যে ক’জন আমদানিকারক গ্যারেজ লাইসেন্সের বিপরীতে পুরনো ইঞ্জিনসহ বিভিন্ন আইটেম আমদানি করে, তাদের একজনেরও কোনো গ্যারেজ নেই। বিভিন্ন সংস্থাকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে চক্রটি সরকারকে বছরে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত এবং শত শত কোটি ডলার পাচার করে আসছে।
সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তা চক্রটির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এরা দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। চট্টগ্রামের পণ্য কেন ঢাকায় নিয়ে খালাস করা হচ্ছে তার অনুসন্ধান এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমসের একজন কর্মকর্তা গতকাল আজাদীকে বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে আমরা অভিযোগ পাচ্ছিলাম। তাই কিছুটা কড়াকড়ি করার পর বেশ কয়েকটি কন্টেনার আটক করেছি। এগুলো খালাসের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করা হলেও ছাড়া হয়নি। আমদানিকারকদের কাগজপত্র দেখে আমরা পণ্যের শুল্কায়ন করে থাকি। এক্ষেত্রে কার গ্যারেজ আছে বা নেই সেটি দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়। লাইসেন্সের বিপরীতে পণ্য আমদানি হবে। তবে আমদানি নিষিদ্ধ কোনো পণ্য যাতে দেশে প্রবেশ না করে সেদিকে আমরা সতর্ক থাকি।