চলতি বছরের শেষে অথবা আগামী বছরের শুরুতে দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য অনুযায়ী। তাই জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও রাজপথে থাকা বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। কোথাও কোথাও রক্তও ঝরছে।

নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নে উভয় শিবিরই কঠোর অবস্থানে। আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে এবং বিএনপি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবিতে অনড়। এই অবস্থায় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দলটির অনুকূলে ঝুঁকবে, তা দেখার অপেক্ষায় ইসলামী দলগুলো। দলগুলোর নেতারা বলছেন, রাজপথের সাফল্য দেখে তারা সিদ্ধান্তগ্রহণ করবেন।

কয়েক মাস আগে ইসলামী দলগুলো নিয়ে একটি জোট গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। জানতে চাইলে দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া উপকমিটির সহকারী সমন্বয়কারী শহিদুল ইসলাম কবির আমাদের সময়কে বলেন, আমরা এখন সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও সংগঠনকে শক্তিশালী করা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছি। সিটি নির্বাচনের পরে জোট গঠনের বিষয়ে ভাবা যাবে।’ ইসলামী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, যাদের সঙ্গে জোট গঠনের কথা ছিল, তারাও নানা চাপে রয়েছে। যার কারণে জোট গঠন প্রক্রিয়া থমকে আছে।

দেশে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইসলামপন্থি দলের সংখ্যা ১০টি। এর মধ্যে পাঁচটি দল এক সময় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে (বর্তমানে বিলুপ্ত) থাকলেও বিভিন্ন সময় তারা বের হয়ে গেছে। মূলত এই দলগুলোকে নিয়েই একটি নির্বাচনী সমঝোতার চেষ্টা হচ্ছে।

দলগুলো হচ্ছে- প্রয়াত শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, মুফতি আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট, মুহাম্মদ ইসহাক ও আহমদ আবদুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস, শায়খ যিয়াউদ্দিন ও মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীর নেতৃত্বাধীন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও আতাউল্লাহ হাফেজ্জীর বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন। এর বাইরে আছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।

এই দলগুলোর বাইরে থাকা ইসলামী দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট (আবদুর রকিব) ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের (মনসুরুল হাসান) একটি অংশ বিএনপির সঙ্গে আছে। কিন্তু এই তিনটি দলের কোনোটির রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন নেই। এর মধ্যে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধন বাতিল করে আদালত। যদিও জামায়াতের ভাষ্য, আপিল বিভাগে দুটি আপিল বিচারাধীন আছে।

বিএনপি নেতাদের ভাষ্য, ২০ দলীয় জোট থেকে যেসব দল বের হয়েছে, তারা কেউ নিজে থেকে বের হয়নি। সরকারি চাপের কারণে দলগুলো বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এসব দলের নেতাদের সঙ্গে সরকারের সুসম্পর্ক থাকলেও, তাদের কর্মীরা এখনো মনেপ্রাণে বিএনপির সঙ্গেই আছে বলে তাদের বিশ্বাস।

খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমেদ আবদুল কাদের বলেন, আমাদের দলের অবস্থান হচ্ছে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন। দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং ৩শ আসনে একক প্রার্থী দিতে ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে একটি জোট গঠনের চেষ্টা আছে।

অন্যদিকে নিবন্ধিত ইসলামপন্থি অন্য দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক। এ ছাড়া ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ (বাহাদুর শাহ), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (এমএ মতিন) এবং জাকের পার্টিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছে। ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে ঐক্য গড়ার চেষ্টার সঙ্গে থাকা গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, যারা আওয়ামী লীগ জোটে রযেছে বা তাদের ঘনিষ্ঠ, সেসব দলগুলোর পক্ষে অন্য কোনো জোটে বা নির্বাচনী সমঝোতায় যাওয়ার সম্ভাবনা কম।

ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দলের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে ইসলামী দলগুলোকে এক জায়গায় আনার প্রথম উদ্যোগ আসে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকে। এ লক্ষ্যে খেলাফত আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি (একাংশ), মুসলিম লীগসহ (একাংশ) ছয়-সাতটি দলের সঙ্গে প্রথম দিকে কথাও বলেছেন তারা।

দলগুলোর একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি- উভয় বলয়ে ইসলামী দলগুলোর ‘চাহিদা’ আছে। আবার কোনো কোনো দলের সখ্য জামায়াতের সঙ্গে। এ অবস্থায় ‘আন্দোলন ও নির্বাচনী সমঝোতা’ হবে কিনা, তা নির্ভর করবে বিএনপির আন্দোলনের ওপর। রাজনীতির পাল্লা যেদিকে ভারী থাকবে, তাদের সিদ্ধান্তও সেদিকে যাবে।

সম্প্রতি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের এক সভা ভারপ্রাপ্ত আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এ নিয়ে গত ২১ মে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চলমান আন্দোলন বেগবান করার আহ্বান জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে সরকার ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। ফলে দেশে এক ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়। জামায়াত মনে করে, জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে অবিলম্বে দলনিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই চলমান সংকট নিরসন হতে পারে।

জোট গঠনের উদ্যোগের মধ্যে থাকা একটি ইসলামী দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, নানা কারণে সরকারের বিভিন্ন মহলের সঙ্গে ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যার ফলে ইসলামী দলের নেতাদের দৃশ্যমান মনোভাব সরকারের দিকে; কিন্তু তাদের কর্মীদের মনোভাব ভিন্ন। এসব কারণে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোটের পরিবেশ সৃষ্ঠির লক্ষ্যে জোট গঠন প্রক্রিয়া থেমে আছে বলে মনে করেন ইসলামী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ এ নেতা।

বিএনপির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের সঙ্গে কিছু ইসলামী দল সতর্কতার সঙ্গে ‘ভেতরে ভেতরে’ যোগাযোগ রাখছে। দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, জামায়াত বা কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক ইসলামী দলগুলো পরিবেশ পেলে নিজে থেকেই রাজপথে নামবে। জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, আমরা রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর সতর্ক দৃষ্টিও রাখছি।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031