ভারত বৈধ পন্থায় বাংলাদেশে কখনো গরু রপ্তানি করেনি । যা কিছু আসতো সব অবৈধ পন্থায়। কিন্তু এই চোরাচালানই দুই দেশ এক ধরনের বৈধতা দিয়েছিল। নানা পন্থায় সীমান্ত দিয়ে পশু দেশে আসার পর সীমান্তের বাজারে তুলে তা বিক্রি হতো। এরপর তা বৈধ হয়ে যায়। বিনিময়ে সরকারের কোষাগারে যোগ হতো একটি অংক।
তবে গত কয়েক বছর ধরে এই ধারাবাহিকতাতেও ছেদ পড়েছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই গরু ‘রপ্তানি’ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। তবে ফাঁকফোকর দিয়ে যা কিছু গরু আসছে তা বাংলাদেশের চাহিদার তুলনায় বলতে গেলে কিছুই না।
বছরজুড়ে তো বটেই কোরবানির পশুর একটি বড় চাহিদাও মেটাতো এই ভারতীয় পশু। এগুলোর সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে কী হবে, এ নিয়ে রীতিমত উদ্বেগ ছড়ায় দেশে। তবে দুই বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, ভারতীয় এই ‘নিষেধাজ্ঞা’ শাপে বর হয়েছে বাংলাদেশের জন্য।
২০১৫ সালের মার্চে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা সফর করে গরু চোরাচালান বন্ধের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারির পর ভারত থেকে গরু আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকায় বাংলাদেশে বেড়ে যায় গরুর মাংসের দাম।
তবে ভারতের এই সিদ্ধান্তের পর গ্রামেগঞ্জে আগের মতো ব্যাপকভাবে শুরু হয়ে গেছে পশু পালন। গরিব মানুষের জন্য এটা সঞ্চয়েরও একটা সুযোগ। বছরজুড়ে পশু পেলে কোরবানিতে বিক্রি করে যে কয়টা টাকা পাওয়া যায় সেটাই পরিবারের আয় আর সঞ্চয়ের চিত্রটাই পাল্টে দেয়।
ভারত থেকে যখন দেদারসে পশু আসতো তখন বরং এই আয় কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়তো বাংলাদেশের খামারিরা। আবার ভারতীয় পশুর দাম পাইকারিবাজারে তুলনামূলক কম থাকলেও ক্রেতাদের তাতে যে খুব একটা লাভ হতো তা নয়, ফটকা কারবারি আর মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে তখন যেত এই বাড়তি লাভ। আর ক্রেতারা এখনকার দামেই কিনতে বাধ্য হতো পশু। এই হিসাবে বাংলাদেশে পশু আসতে না দিতে ভারতীয় কঠোর নীতি বহুদিক থেকেই লাভ হয়েছে বাংলাদেশের।
এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি পালন ও প্রজনন কর্মসূচির আওতায় জীবিকা নির্বাহ করে। জমিচাষ, ভারবহন এবং গোবরের সার ও জ্বালানি সরবরাহ প্রাণিসম্পদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তার ওপর, প্রাণীর চামড়া, হাড়, নাড়িভুঁড়ি ও পালক ইত্যাদি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সহায়ক। প্রাণিসম্পদ ভূমিহীন মানুষের জীবিকার একটা বড় অবলম্বন।
সংকটের আশঙ্কা নেই সরকারের
কোরবানির আগে প্রতি বছরই পশু মোটাতাজা করার কাজ চলে সারা দেশে। চলতি বছর মোটাতাজা করা পশুর সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি বলে জানিয়েছে প্রাণিসম্পদ বিভাগ।
প্রাণিসম্পদ বিভাগ বলছে, এবারের ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য এক কোটি ১৫ লাখ ৫০ হাজার গরু ছাগল লালন পালন হচ্ছে। এর মধ্যে গরুর সংখ্যা ৪৫ লাখ এবং ছাগল ও ভেড়া ৭০ লাখ মতো।
এই পরিমাণ পশু দিয়ে কি কোরবানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব? প্রাণিসম্পদ বিভাগের হিসাব বলছে, সম্ভব। কারণ গত বছর দেশে কোরবানি হয়েছিল ৩৬ লাখ গরু। কোরবানির পর সংগ্রহ করা চামড়া গণনা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। চলতি বছর কোরবানির সংখ্যা ১০ শতাংশ বাড়লেও তা ৪০ লাখের কম হবে। আর ২০ শতাংশ বাড়লেও লালনপালন করা পশু দিয়ে সহজেই তা সামাল দেয়া যাবে বলে মনে করছে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
তবে চামড়া সংগ্রহের এই হিসাবের বাইরে আরেকটি বিষয় আছে। প্রতি বছরই বেশ কিছু চামড়া পাচার হয় ভারতে। পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয় এই সংখ্যাটা কয়েক লাখ। এই হিসাবটা রাখলেও দেশের ভেতর লালনপালনকারী পশুর দিয়ে কোরবানির চাহিদা পূরণ খুব একটা সমস্যার হবে না বলে আশাবাদী প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবও বলছে, দেশে প্রতি বছর কোরবানির গরুর চাহিদা তৈরি হয় সর্বোচ্চ ৪০ লাখের মতো।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত (আমদনি ও রপ্তানি) সচিব মুন্সী সফিউল হক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা দেশীয় গরুর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। আসন্ন কোরবানির ঈদে পশু সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই।’
বাণিজ্য সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আসন্ন কোরবানির ঈদে পশু সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই। এ কারণে আমাদের বাড়তি কোনো প্রস্তুতি নেই।’
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘গরু সংকটের কথা বলে আতঙ্ক ও গুজব ছড়িয়ে আগেভাগে গরু কেনার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে কৃত্রিম চাহিদা তৈরির চেষ্টা করছে একটি চক্র। গত বছরও এই কাজ করেছে তারা। এতে করে বাড়তি চাহিদার কারণে শুরুর দিতে পশুর দাম বেড়ে যায়। কিন্তু পরে দাম ঠিকই কমে এসেছিল।’
মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেছেন, গরু রপ্তানিতে ভারতে সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা বহাল আছে। তবে কোরবানির আগে কিছুটা শিথিল থাকে সীমান্তে বিএসএফের নজরদারি। ঈদের গরুর হাট বসা শুরু হলে সবার কাছে তা স্পষ্ট হবে।
ভারত থেকে কত পশু আসে?
অন্যান্য অনেক হিসাবের মতো এ বিষয়েও সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে ধারণা করা হয় দুই বছর আাগেও কোরবানির পশুর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ আসতো ভারত থেকে। তবে এই ভারত নির্ভরতা কমে আসছে। এই হিসাবে এই মৌসুমে ভারতীয় গরু আসতো পাঁচ থেকে সাত লাখের মতো। সারা বছরের হিসাব করলে সেটা ১০ থেকে ১৪ লাখের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো বলেই ধারণা প্রাণিসম্পদ বিভাগের।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অজয় কুমার রায় ঢাকাটাইমসকে বলেন, এবারও আগেভাগেই খামারিরা জানতে পেরেছেন ভারতীয় গরু আসবে না। তাই তারা ভালো দামের আশায় গরু মোটাতাজাকরণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে দেশীয় জোগান এবার অন্যান্য বছরের চেয়ে কমপক্ষে দুই থেকে তিন লাখ গরু বেশি বাজারে উঠবে।
দেশে কত পশু আছে
বাংলাদেশে গবাদিপশু পালন পালনের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। গ্রাম অঞ্চলে সবাই খামার করে পশু পালেন না। নিজ ঘরের পাশেই গোয়াল ঘরে একটি দুটি পশু পালার হিসাব কখনও সরকারি খাতায় উঠে কি না তা নিশ্চিত নয়।
তারপরও প্রাণিসম্পদ বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে দেশে প্রাণিসম্পদের একটি হিসাব আছে অধিদপ্তরে।
অধিদপ্তরের তথ্য মতে, সারাদেশে গরুর খামার রয়েছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার। তবে কোরবানির ঈদের আগে এই খামারের সংখ্যা বেড়ে যায়। ছয় মাস বা তার চেয়ে কম সময় পশু পালন করে মোটাতাজা করার পর তা বিক্রির চল আছে। এসব ছোট ছোট খামারে একটি-দুটি বা কখনও তার চেয়ে বেশি পশু লালনপালন হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ তথ্যমতে, দেশে গরু আছে প্রায় দুই কোটি ৮৬ লাখ। মহিষের সংখ্যা সোয়া ছয় লাখের কিছু বেশি। আর ছাগলের সংখ্যা প্রায় এক কোটি ৯৫ লাখ। ভেড়া আছে ১৫ লাখের কিছু বেশি।
এই পশু লালনপালন করে অর্থনীতিতে বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা যুক্ত হয় বলে পরিসংখ্যার ব্যুরের হিসাবে দেখা যায়। এই পরিসংখ্যানটি ২০১৫ সালে প্রকাশ হয়েছে।
অন্য একটি হিসাবে দেখা যায়, দেশে গবাদি পশুর সংখ্যা প্রতি বছর ৫.৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। আগামী ২০২১ সাল নাগাদ জাতীয় উৎপাদন থেকে দেশের চাহিদা মেটাতে হলে এসব উপজাতের উৎপাদন ন্যূনপক্ষে বছরে গড়ে শতকরা ৬ থেকে ৯ ভাগ হারে বাড়িয়ে যেতে হবে। সে জন্যে প্রাণি-পাখি উপখাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। প্রাণি-পাখির গবেষণা ও সম্প্রসারণ খাতে প্রতি ১ টাকা বিনিয়োগ করা হলে বছরে গড়ে আয় হবে পণ্যভেদে ১.৪২ থেকে ৩.১৫ টাকা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে বছরে এক কোটি ৪০ লাখের মতো গরু ও মহিষ জবাই হয়।
পশুপালনে উৎসাহ দিচ্ছে সরকার
পশু পালনে উৎসাহ দিতে সরকার খামারিদেরকে পাঁচ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে। পশু কেনা ও লালনপালন করলে এই সুবিধা পাওয়া যায়। চলতি অর্থবছর থেকে এই সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেট পেশের সময় সংসদে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এই খাতে সরকার তিন বছর মেয়াদী একটি সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
গবাদিপশুর খাদ্য সরবরাক ব্যবস্থাকে দুর্বল অভিহিত করে জনগণের পুষ্টির চাহিদা বিবেচনায় চতুষ্পদ প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে পাইলট প্রকল্প গ্রহণের প্রস্তাবও করেছেন অর্থমন্ত্রী।