চীনের কোনো যুবককে যদি এ প্রশ্ন করা হয়, সে লজ্জা পেয়ে এদিক ওদিক তাকাবে।‘তোমার কি কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে?’ তারপর দ্রুত প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাবে। আমেরিকান লেখক ও সাংবাদিক পিটার হেসলার চীনের লোকদের গড় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের একটা ছবি তুলে ধরতে গিয়ে এমনটাই বলেছেন। তবে তার মতে সমসাময়িককালে খুব দ্রুত বদলাতে শুরু করেছে চীনের লোকের অর্ন্তমুখী স্বভাব। বিশেষ করে দেশটির মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখন অনেকটাই বহির্মুখী। অর্থনৈতিক ভাবে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা মধ্যবিত্তের ক্ষমতা আর চাহিদা দিনকে দিন বাড়ছে।মধ্যবিত্তের আশা আকাঙ্খার জায়গাটি এমনভাবে বদলাতে শুরু করেছে যে দেশটির সরকারের অস্তিত্বের জন্য যে কোন সময় বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠতে পারে নব্য মধ্যবিত্তের উত্থান। আর পিটারের ধারণা, নব্য এ শ্রেণি বিপ্লবের মুখে পড়লে টলে উঠবে চীনা সরকারের খুঁটি। একটু এদকি ওদকি হলেই বিপদের কারণ হয়ে দাড়াতে পারে নব্য মধ্যবিত্তের বিস্তার । সম্প্রতি ‘দি ইকোনোমিস্ট একটি বিশেষ গবেষণা প্রতিবেদনে চীনের মধ্যবিত্ত শ্রেণির এই অর্ন্তনিহিত চিত্রটি তুলে ধরেছে ।
গত কয়েক দশকে চীনের অর্থনৈতিক উত্থানে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো লাভবান হয়েছে সবচেয়ে বেশি । বর্তমানে চীনে মধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্যা দুইশ ২৫ মিলিয়ন। তাদের বার্ষিক আয় গড়ে ১১ হাজার ৫০০ থেকে ৪৩ হাজার ডলার। অনুমান করা হচ্ছে ২০২০ সালের মধ্যে আরো ৫০ মিলিয়ন পরিবার মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে যোগ দেবে। এদের বেশির ভাগ লোক শহরে বাস করে । তাদের ৮০ শতাংশেরই নিজস্ব সম্পত্তি আছে। এমনকি শাসনক্ষমতায় থাকা স্বয়ং চীনা সমাজতান্ত্রিক দলেরই ৮৮ মিলিয়ন সদস্য মধ্যবিত্ত শ্রেণিভূক্ত। বিশ্বব্যাপী পরিব্যপ্ত ম্যানেজম্যান্ট কনসালটেন্ট ফার্ম ‘ম্যককিনসেই’তাদের এক গবেষণায় পাওয়া এ তথ্য দিয়েছে ।
মোটের উপর চীনের জন সাধারনের বড় অংশই বয়স্ক। কিন্ত শহরে বাস করা মধ্যবিত্ত শ্রেণির গড় বয়স ৩৫ এর নিচে। নিজ দেশের দারিদ্র্যের চিত্র তাদের স্মৃতিতে নেই। তাদের পূর্বপুরুষরা কৃষক ছিলেন। খুব বেশি হলে কারখানার শ্রমিক। কিন্ত তারা এখন নিজেরা শহরের সবচেয়ে ব্যায়বহুল স্কুলে সন্তানদের পড়তে পাঠাচ্ছে , দেশে বা বিদেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার স্বপ্ন দেখার সাহস রাখে। এখনকার যুবসমাজ নিজেদের ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন, সমাজ বা দেশ কি চায় তা তাদের কাছে অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। দেশটির গণমাধ্যমে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের সোচ্চার উপস্থিতি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। তাহলে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি আসলে কী চায়, আর তাদের আকাঙ্খার জায়গাটাই বা ঠিক কোথায় ?১৯৪৯ সালে যখন সমাজতান্ত্রিক দল ক্ষমতা দখল করে নেয়। ১৯৮৯ সালে বেইজিংয়ে তিয়ানানম্যান স্কয়ারে ছাত্র ও জনগন সরকারি নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে অন্দোলন করে। এই আন্দোলনের অবসান ঘটে সরকারের নির্মম হস্তক্ষেপে। সেনা অক্রমণে প্রাণ হারায় দুই হাজারের্ও বেশি মানুষ। এই ঘটনার পরও চীনের জনগণ নীরব থাকে কারণ সমাজতান্ত্রিক দল দেশটির মানুষের জন্য সার্বিক অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এনে দিয়েছে।
মানুষ সম্পদ অর্জনের একটা লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়ার পর , অবস্তুগত মূল্যবোধের সন্ধান করে, দর্শনের নিয়ে ভাবে। চীনের লোকেদের রাজনৈতিক জীবনেও তাই ঘটেছে । আজকের চীনের অনেকেই স্বতন্ত্রবাদী এবং সমাজের পরিবর্তন চেয়ে সোচ্চার। কেন না দূর্নীতি, আয় বৈষম্য আর পরিবেশ দূষণের ক্রমাগত বিস্তারে চীনের সাধারণ মানুষ লম্বা সময় ধরে হতাশায় ভুগছে। দীর্ঘ ৩৫ বছরের চোখ ধাঁধানো প্রবৃদ্ধির অন্ধকার দিকটির মুখেমুথি দাড়িয়ে আছে তারা।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির অসন্তোষ নিয়ে যথেষ্ট ভয়ে আছে চীনা সরকার। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ২০১৩ সালে প্রণীত অভ্যন্তরীণ একটি গোপন দলিলে। এতে সাতটি বিষয়কে প্রকাশ্যে নিষিদ্ধ করা হয়। এর মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে পার্টির ঐতিহাসিক ভূল , সার্বজনীন মূল্য বোধ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা।
সরকারের কোনো স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা ছাড়া চীনের সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে, এটা চিন্তা করা বোকামি। প্রেসিডেন্ট শি জিংপিংয়ের সরকারকে বুঝতে হবে যে, কোনো আইনের শাসন ছাড়া ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিরাপদ নয়। সরকারের কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ছাড়া দূর্নীতি বন্ধ করা যায় না। আর বাক স্বাধীনতা না থাকলে, নিজের মত প্রকাশ করার অধিকার না পেলে জনগণ শুধুমাত্র সম্পদ আর স্বচ্ছলতায় সুখী হতে পারে না।