বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ২০০৮ সালের ৬ অক্টোবর ফেনী সদরের ধর্মপুর সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৩০ বোতল ফেনসিডিলসহ দুই ভাই জাফর হোসেন ও আলী হোসেনকে আটক করে । এ ঘটনায় বিজিবির এক হাবিলদার বাদী হয়ে ফেনী মডেল থানায় মামলা করেন। পুলিশ মামলাটি তদন্ত করে একই বছরের ৩১ ডিসেম্বর দুই ভাইকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। পরে এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হলেও দীর্ঘদিন কেটে যায় সাক্ষ্যগ্রহণে। মামলার নয় সাক্ষীর মধ্যে পাঁচ জন সাক্ষ্য দেন। অবশেষে ১৭ বছর পর গত ৩১ জানুয়ারি এই মামলায় রায় ঘোষণা করেন ফেনীর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ মো. কায়সার মোশাররফ ইউসুফ। রায়ে আসামি জাফর হোসেন ও আলী হোসেন দুই ভাই খালাস পান। যদিও রায় ঘোষণার সময় তারা পলাতক ছিলেন। শুধু এ মামলাই নয়, মাদকের বেশির ভাগ মামলায় আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছেন।
গত আট বছরে মামলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিবছর যেসব মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে গড়ে ৪৩ শতাংশ মামলায় সাজা হয়েছে। আর বাকি ৫৭ শতাংশ মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। এই আট বছরে মোট ১৬ হাজার ৩৭৫টি মামলার রায় দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭ হাজার ১টি মামলার আসামিদের সাজা হলেও বাকি ৯ হাজার ৩৭২টি মামলার আসামিরা খালাস পেয়েছেন। আসামির সংখ্যায় ৭ হাজার ৯৫৪ জনের সাজা হয়েছে; আর ১০ হাজার ৭৮৯ জন খালাস পেয়েছেন।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাদক হাতেনাতেসহ আসামি গ্রেপ্তারের পরও একটা বড় অংশের ক্ষেত্রে মামলা প্রমাণিত না হওয়ার জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, মাদকের মামলায় আদালতে সাক্ষী উপস্থাপনই বড় চ্যালেঞ্জ হওয়ায় আসামিরা পার পেয়ে যান। মাদক কারবারিদের পক্ষ থেকে সাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদান ছাড়াও বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করা হয়ে থাকে বলে আসামিরা ছাড় পাচ্ছেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছর (২০২২) ১ হাজার ১৩৫টি মাদক মামলার বিচার নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৫৩৪টি মামলায়, অর্থাৎ ৪৭ শতাংশ ক্ষেত্রে সাজা হলেও ৬০১টি মামলায় (৫৩ শতাংশ) আসামিরা খালাস পেয়েছেন। আর আসামি সংখ্যার দিকে ৫০২ জনের সাজা হলেও ৬৬২ জন খালাস পেয়েছেন। এর আগে বছর ২০২১ সালে ১ হাজার ৬৬৪টি মামলার রায় হলেও মাত্র ৪০ শতাংশ (৬৬১টি মামলা) সাজা হয়েছে; বাকি ৬০ শতাংশ (১০০৩টি মামলা) মামলার আসামিরা খালাস পান। এ বছর আসামিদের সংখ্যার দিকে ৮৪২ জনের সাজার বিপরীতে ১ হাজার ৬৯৩ জন খালাস পান।
২০২০ সালে ৭২২টি মামলার রায় হয়। এর মধ্যে ৪৩ শতাংশ মামলার (৩১০টি) আসামিদের দ- হয় এবং ৫৭ শতাংশ মামলায় (৪১২টি) আসামিরা খালাস পান। এ বছর আসামিদের সংখ্যার দিক থেকে ৩৩৩ জনের সাজা হয়েছে; আর ৪৩৩ জন খালাস পেয়েছেন। ২০১৯ সালে ১ হাজার ৬৫৪টি মামলার রায় হয়। এতে ৩৯ শতাংশ (৬৪২টি) মামলায় সাজা হয় এবং ৬১ শতাংশ মামলায় (১০১২টি) আসামিরা খালাস পান। এ বছর আসামিদের সংখ্যার দিকে ৬৭৮ জনের দ- হলেও বাকি ১ হাজার ৭৮ জন খালাস পান।
২০১৮ সালে ১ হাজার ৪৩৫টি মামলার হয়। এর মধ্যে ৪১ শতাংশ মামলায় (৫৯২টি) সাজা হয় এবং বাকি ৫৯ শতাংশ মামলায় (৮৪৩টি) আসামিদের খালাস দেওয়া হয়। এ বছর সংখ্যার দিকে ৬৩১ জনের দ- হলেও আরও ৯১১ জন আসামি খালাস পায়। ২০১৭ সালে মাদকের ২ হাজার ৫৪৪টি মামলার রায় হয়। এর মধ্যে মাত্র ৪০ শতাংশ মামলায় (১০১৬টি) সাজা হয় এবং ৬০ শতাংশ মামলার (১৫২৮টি) আসামিরা খালাস পান। ওই বছর আসামিদের সংখ্যার দিকে ১ হাজার ৬৫ জনের দ- হলেও আরও ১ হাজার ৬১৫ জন খালাস পায়।
গত কয়েক বছরের মধ্যে ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৩৪৮টি মাদক মামলার রায় হয়। এসব মামলায়ও খালাস পরিমাণ বেশি। ওই বছর ৪৪ শতাংশ মামলায় (২৩৫৬টি) আসামিদের সাজা হলেও বাকি ৫৬ শতাংশ মামলার (২৯৯২টি) আসামিরা খালাস পায়। একই বছর আসামিদের মধ্যে ২ হাজার ৯২৭ জনের সাজা হলেও আরও ৪ হাজার ২০৬ জন খালাস পায়। এর আগে ২০১৫ সালে ১ হাজার ৮৭৩টি মামলার রায় দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৪৮ শতাংশ মামলার (৮৯২টি) আসামিদের সাজা হলেও বাকি ৫২ শতাংশ মামলায় (৯৮১টি) আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। ওই বছর আসামিদের মধ্যে ৯৭১ জনের দ- নিশ্চিত হলেও আরও ১ হাজার ৪২ জন খালাস পান।
মাদক মামলার আসামিদের বড় অংশ সাজা না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. বজলুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘যারা মাদকের কারবার করে তারা মাদক নিজেদের আয়ত্তে বা ঘরে রাখে। যখন অভিযানে গিয়ে তাদের কাউকে মাদকসহ আটক করা হয় তখন প্রত্যক্ষদর্শী খুব কমই পাওয়া যায়। সেই মুহূর্তে স্থানীয় যারা অর্থাৎ আশপাশের প্রত্যক্ষদর্শী তাদের সাক্ষী করা হয়। ওইসব সাক্ষীরা ঘটনার সময় যে জব্দ তালিকার সাক্ষ্য দেন, পরে দেখা যায় আদালতে গিয়ে অন্যভাবে বলছেন। মামলার বিচার শুরু হলে আদালত সাক্ষ্য নেওয়ার সময় যে সাক্ষ্য দেন, তার আগের বক্তব্যের সঙ্গে মিল থাকে না, এ জন্য প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।’
এ ছাড়া মাদক কারবারিরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে আদালতে না যাওয়ার জন্য প্রভাব বিস্তার করে থাকে জানিয়ে বজলুর রহমান বলেন, ‘এটা আরেকটি সমস্যা। মাদক কারবারিরা অনেক শক্তিশালী থাকে। তারা যখন কাউকে হুমকি-ধমকি কিংবা ভয়ভীতি দেখান তখন অনেক সাক্ষী আদালতে উপস্থিত হয় না। তখনও মামলা প্রমাণের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়।’
মাদক মামলার বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে আসামি খালাস পেয়ে যায় জানিয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু আমাদের সময়কে বলেন, ‘অনেক সময় মামলা যখন দায়ের করা হয় সে এজাহার দুর্বল থাকে, আবার চার্জশিটও যদি দুর্বল হয়, অনেক সময় সঠিকভাবে সাক্ষ্য দিল না, তখন মামলা প্রমাণ করা যায় না, তখন আসামিরা পার পেয়ে যায়। তখন আদালতেরও কিছু করার থাকে না।’
তিনি বলেন, ‘মাদক মামলায় যখন এফআইআর দায়ের করা হবে তখন নির্ভুল যেন হয়। এর ভেতর যেন কোনো ফাঁকফোকর না থাকে। একই সঙ্গে নির্ভুল একটি চার্জশিট দিতে হবে। ঘটনাস্থলের সাক্ষীর যেন সাক্ষ্য নেওয়া হয়।’