নিঃসন্দেহে তারা দুর্ভাগা ব্যতিক্রমী এই রোজার মাস পেয়েও যারা নিজেদের জীবনকে আলোকিত ও দ্যুতিময় করতে ব্যর্থ হয়েছে । রোজার মাসে পরিশুদ্ধি অর্জনে যারা সক্ষম হয়নি তারাও চরম দুর্ভাগা। রোজার মাসে মানবিক গুণাবলীর সর্বোত্তম বিকশিত রূপ দেখা যায় রোজাদার মুসলমানদের জীবনে–চলনে।
আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম ও আত্মনির্মাণের অবারিত সুযোগের সদ্ব্যবহার যদি সত্যি সত্যি করা হয়ে থাকে তবে এর রেশ–বিভা–দ্যুতি ছড়াবে হয়তো আগামী দিনেও। রমজানের বিদায়ের সাথে সাথে আবারও যেন আমরা স্বেচ্ছাচারী বল্গাহীন জীবনচারিতায় ধাবিত না হই– সেই চেষ্টা ও বোধের উজ্জীবন খুব বেশি জরুরি।
মহান আল্লাহ পাক মানুষকে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাকে নানাভাবে পরিশুদ্ধ হবার দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। মানুষকে পরিশীলিত করবার জন্য ইসলামের রয়েছে ব্যাপক কর্মউদ্যোগ এবং নিয়ম–শৃঙ্খলা। মানুষের মধ্যে খারাপ প্রবৃত্তি ও অসংযমতা যাতে বাসা না বাঁধে সেজন্য রয়েছে নানামুখী বিধান ও
সর্বাত্মক আয়োজন। সমস্ত কলুষতা ও হীনম্মন্যতা থেকে দূরে থেকে মানুষ যেন আদর্শবাদী ও আত্মসমর্পিত চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, বিশ্বাসের শুভ্র আলোয় তার চিত্ত যেন পরিশুদ্ধ থাকে, অন্যের প্রতি তার আচার–ব্যবহার, বদান্যতা, আন্তরিকতা, অনুকম্পা, সহানুভূতি, মমতার গুণ বিকশিত হতে পারে তারই প্রশিক্ষণ
মাহে রমজানে উত্তমভাবে নেয় বান্দারা। মহান আল্লাহ একদল শুদ্ধ মানুষকে চান যারা নিজেদের আলোকিত করে অন্যদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। পরিশুদ্ধ, মুত্তাকি, আত্মসমর্পিত সংঘবদ্ধ মানুষ তৈরির জন্যই শুদ্ধ ও সুষ্ঠু কিছু ধর্মীয় কৃচ্ছ্রসাধনা ও পদ্ধতি প্রণীত হয়েছে ইসলামে। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে
মানুষ সেই শুদ্ধতার শীর্ষে পৌঁছতে পারে। একটি মাস, রমজান মাসের প্রতিটি দিন সকাল–সন্ধ্যা–রাত একটি মানুষকে পরিশীলিত ও সংযমী মানুষে রূপান্তরের সর্বাত্মক আয়োজনে শামিল করে। মানুষ তার লোভ লালসা, কাম, ক্রোধ দমন করে এবং কুপ্রবৃত্তি থেকে দূরে সরে থেকে সে নম্রতা, সংযম, উদারতা শিষ্ঠতা
ইত্যাদি মানবিক গুণাবলীতে সমৃদ্ধ হয় এবং আল্লাহর প্রতিনিধিরূপে নিজেকে পূর্ণতা দিতে পারে। মানুষের জন্য তাই সিয়াম সাধনা উৎকৃষ্ট গুণাবলী অর্জন ও আত্মশুদ্ধির পাথেয়স্বরূপ। যাবতীয় পাপাচার, অনাচার থেকে বিরত থাকা, আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম, ষড়রিপুর নিয়ন্ত্রণ, মিথ্যা ও পরনিন্দা পরিহার এবং অন্যায়–
অরাজকতা থেকে নিজেকে দূরে রেখে একাগ্রচিত্তে ইবাদতে– রিয়াজতে নিবেদিত থাকার মাস এ রমজান। আর্দ্রতার কারণে যেমন লোহার মতো কঠিন ধাতুতেও মরিচা ধরে যায় তেমনি পাপের কালিমা সাধারণ মানুষের অন্তরকে আচ্ছাদিত করে দেয়। ফলে অসুস্থ অন্তরাত্মার পক্ষে সুস্থ বা মহৎ কিছু করার অবস্থা থাকে
না। কিন্তু মাহে রমজান ইবাদত, রিয়াজত, সাধনা ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মানবাত্মার রোগ নিরাময়ের সুযোগ এনে দেয়। রোজাদারগণ সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিবিষ্ট চিত্তে পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি হতে বিরত থেকে আল্লাহর যাবতীয় বিধি–নিষেধ মেনে চলে। ফলে তাদের অন্তর পুণ্যের আলোকে উদ্ভাসিত
হয়ে ওঠে। তাই অপরাধমুক্ত ও কল্যাণধর্মী জীবনধারার প্রবর্তক মাহে রমজানে চিন্তায় ও কর্মে আমাদেরকে পরিশুদ্ধ হবার চেষ্টা করে যেতে হবে।
মাহে রমজান আল্লাহর পুণ্যাত্মা বান্দাদের জন্য ইবাদতের বসন্তকাল। রমজ শব্দের এক অর্থ হল বসন্তকালের বৃষ্টি। বসন্তকালের এ বৃষ্টি প্রকৃতিতে আনে সজীবতা, মানুষের মধ্যে ফিরে আসে প্রাণচাঞ্চল্য। বসন্তের দখিনা বায়ুর স্পর্শে গাছপালা তরুলতা ও প্রাকৃতিক জগত শীতের জীর্ণতা ঝেড়ে ফেলে তাপপ্রবাহে
মুখরিত হয়ে ওঠে, বৃক্ষরাজি পত্র পল্লবে সুশোভিত ও সৌন্দর্যময় হয়ে ওঠে, পাখ–পাখালির কুজনে পৃথিবীতে বয়ে চলে সুর মঞ্জুষার নহর। ঠিক তেমনি মাহে রমজানে ঈমানদার জনতা নতুন উদ্দীপনায় আমলের সাজে সজ্জিত হয়ে আনন্দের হিল্লোলে মেতে ওঠে। রহমতের করুণাধারায় সিক্ত মানবজীবন অন্যরূপ
ধারণ করে। কঠিন সিয়াম সাধনা ও ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নৈকট্যবর্তী হবার সুযোগ পায় এ মাহে রমজানে। অভুক্ত থেকেও রোজাদার পরম প্রাপ্তির আনন্দে প্রাণবন্ত ও উচ্ছ্বাসমুখর থাকে সারাদিন। মহান স্রষ্টার নির্দেশ পালনে সংযম সাধনা ও উপবাসব্রত পরাকাষ্ঠার নজির রেখে মানুষ পুণ্যস্নানে
অবগাহন করে জান্নাতি পুলক অনুভব করে। প্রচণ্ড খরা শেষে এক পশলা বৃষ্টি যেমন উত্তপ্ত চৌচির মাটিকে অতৃপ্ত সুধা পান করায় তেমনি দীর্ঘ এগার মাস পর মাহে রমজান মুমিন বান্দাদের পাপরাশি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দিয়ে যায় আল্লাহ পাকের রহমতের বারিধারায়।