বড় জাহাজ বার্থিং শর্তের বেড়াজালে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে । দুইটি ট্রায়াল বার্থিং দেয়ার পর সবকিছু ঠিকঠাক থাকায় দিনকয়েক আগে ২শ’ মিটার লম্বা এবং ১০ মিটার ড্রাফটের বড় জাহাজ ভিড়ানোর সার্কুলার জারি করা হলেও গত ৩ এপ্রিল জারি করা নতুন ড্রাফট চার্টে এক নানা শর্তের বেড়াজাল তৈরি করা হয়েছে। আগের সার্কুলারটি বিশ্বের শিপিং সেক্টরে ছড়িয়ে দেয়ার পর শর্ত সাপেক্ষের নতুন ড্রাফট চার্ট নতুন করে আলোচনার সৃষ্টি করেছে।
চট্টগ্রামের শিপিং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন এই সার্কুলারে বন্দরে বড় জাহাজ বার্থিং দেয়া সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে বড় জাহাজ আসলে চট্টগ্রাম বন্দর বেকায়দায় পড়বে। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলেছে, এটি একটি সাময়িক সমস্যা। ঠিক হয়ে যাবে। নতুন ড্রাফট চার্টের ফলে কোনও সংকট সৃষ্টির আশংকা নেই বলেও কর্মকর্তারা জানান।
সূত্র জানায়, ১৮৮৮ সালের ২৫ এপ্রিল মাত্র দুইটি মুরিং টাইপের জেটি নিয়ে কার্যক্রম শুরু হওয়া চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩৫ বছরের ধারাবাহিকতায় চলতি বছরে বড় জাহাজ বার্থিং দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বছরে গড়ে চার হাজারেরও বেশি জাহাজের আনাগোনা এই বন্দরে। গত বছরও ৩২ লাখ টিইইউএস–এরচেয়ে বেশি কন্টেনার হ্যান্ডলিং হয়েছে।
৭০ এর দশকে চট্টগ্রাম বন্দরে ১৬০ মিটার লম্বা এবং ৭.৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ানো হতো। ১৯৮০ সালে এসে প্রথম ১৭০ মিটার লম্বা এবং সাড়ে ৮ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বার্থিং দেয়া হয়। ১৯৯০ সালে এসে ড্রাফট না বাড়িয়ে ল্যান্থ বাড়িয়ে ১৮০ মিটার লম্বা এবং সাড়ে ৮ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বার্থিং
দেয়া শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে এসে শুরু হয় ১৮৬ মিটার লম্বা এবং ৯.২ মিটার ড্রাফটের জাহাজ। ২০১৪ সালে বার্থিং দেয়া হয় ১৯০ মিটার লম্বা এবং ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ।
এর প্রায় দশ বছর পর ১৯ মার্চ সার্কুলার জারি করে বন্দরে ২০০ মিটার লম্বা এবং ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বার্থিং দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক বিশ্বখ্যাত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এইচআর ওয়েলিংফোর্ড এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সমীক্ষা পরিচালনার পর চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ বার্থিং দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু ঝড় বৃষ্টির মৌসুম শুরু হওয়ার আগ দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গত ৩ এপ্রিল নতুন ড্রাফট চার্ট প্রকাশ করে। যাতে ২০০
মিটার লম্বা ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বার্থিংয়ের ক্ষেত্রে শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। বন্দরের ডেপুটি কনজারভেটর স্বাক্ষরিত সার্কুলারে বলা হয়, ১৮৬ মিটার লম্বা জাহাজই কেবল ১০ মিটার ড্রাফট নিয়ে বন্দরের জেটিতে বার্থিং নিতে পারবে। এছাড়া ১৮৬ মিটার থেকে ১৯০ মিটার লম্বা জাহাজ হলে বার্থিং পাওয়া যাবে
৯.৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ। ১৯০ থেকে ২০০ মিটার লম্বা হলে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজই কেবল বার্থিং পাবে। বন্দরের জেনারেল কর্গো বার্থের ৯ থেকে ১৩ এবং সিসিটির তিনটি বার্থ এবং এনসিটির ২. ৩ এবং ৪ নম্বর বার্থের জন্য উপরোক্ত শর্তগুলো আরোপ করা হয়েছে।
এসব শর্তের কারণে বন্দরে ২০০ মিটার লম্বা এবং ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ানোর যে সার্কুলার বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়েছে সেটি অকার্যকর হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করে একাধিক শিপিং বিশেষজ্ঞ বলেছেন, এতে সংকট তৈরি হবে। বড় যেসব জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসার প্রস্তুতি নিয়েছিল সেগুলো আসতে পারবে না।
চট্টগ্রাম বন্দরের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা নতুন ড্রাফট চার্টে শর্তারোপের কথা স্বীকার করে বলেছেন, ঝড় তুফানের মৌসুম শুরু হচ্ছে। তাই সতর্কতা হিসেবে নতুন ড্রাফট চার্ট দেয়া হয়েছে। বড় জাহাজের ব্যাপারে আরোপিত শর্তগুলো সাময়িক। এগুলো সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। আগের সার্কুলার
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নতুন সার্কুলারও একইভাবে শিপিং এজেন্টদের মাধ্যমে ছড়িয়ে যাবে। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
উল্লেখ্য, ১৯০ মিটার লম্বা বা ৯.৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজে ২২শ’ থেকে ২৬শ’ টিইউএএস কন্টেনার বোঝাই করা যায়। মাত্র আধা মিটার ড্রাফট বৃদ্ধি এবং ১০ মিটার ল্যান্থ বৃদ্ধি করে ১০ মিটার ড্রাফট এবং ২০০শ’ মিটার ল্যান্থের জাহাজে ৩৮শ’ টিইইউএস পর্যন্ত কন্টেনার বোঝাই করা যায়। ১০ মিটার ল্যান্থ বাড়ার
কারণে গড়ে ১ হাজার কন্টেনার বাড়তি পণ্য বোঝাই করার সুযোগ তৈরি করবে। মূলত দুইশ’ মিটার লম্বা ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজকে ‘বড় জাহাজ’ বিবেচনা করা হয়।
একইভাবে বাল্ক কার্গোবাহী জাহাজগুলোর ক্ষেত্রেও ১০ মিটার ল্যান্থ এবং আধা মিটার ড্রাফট বৃদ্ধির ফলে গড়ে ১০ হাজার টন বেশি পণ্য পরিবহন করা সম্ভব হবে। কন্টেনার এবং খোলা পণ্য বেশি পরিবহনের সুযোগ তৈরির বিষয়টি দেশের আমদানি রপ্তানি পণ্য পরিবহন খরচ বহুলাংশে কমে যাওয়ার একটি সুযোগ তৈরি হলেও আপাতত তা আর হচ্ছে না বলেও সূত্র জানিয়েছে।