মৌলভীবাজারে শতাধিক কৃষকের ‘ব্রি ২৮’ ধান নষ্ট হয়ে গেছে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে। নষ্ট হওয়া ধান কেউ গোখাদ্য হিসেবে কেটে নিচ্ছেন, কেউ ফেলে রাখছেন জমিতেই। এবার লাভ তো দূরের কথা, বোরো আবাদের খরচ তোলা নিয়ে কৃষকরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। গবেষকরা বলছেন, সম্ভাব্য দুটি কারণে চিটা হতে পারে। একটি কারণ হলো ঠাণ্ডা আবহাওয়া; আরেকটি ‘ব্লাস্ট’। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করছে। সরকারের বরাদ্দ এলে তা ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া হবে।
এদিকে ব্রি ২৮ নিয়ে কৃষি বিভাগ ও স্থানীয় কৃষকরা পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করছেন। কৃষি বিভাগ বলছে, ‘ব্রি ২৮’ চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। অন্যদিকে কৃষকরা বলছেন, বীজের দোকানগুলো উচ্চফলনের কথা বলে তাদের কাছে ‘ব্রি ২৮’ বিক্রি করেছেন।
শ্রীমঙ্গল হাইল হাওরের কৃষক ইউছুপ মিয়া বলেন, তিনি হাওরের নিচু অংশে ১৫ বিঘা জমিতে ব্রি ২৮ জাতের ধান চাষ করেন। ধান যখন পাকা শুরু করে, তখন চিটা হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন। কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিয়েও কোনো লাভ হয়নি। তিনি জানান, তার নিজের গ্রাম ইউছুপুর, পাশের নোয়াগাঁও ও রাজাপুর গ্রামের কয়েকশ কৃষকের শত শত একর জমির ধানে চিটা হয়েছে। একই এলাকার কৃষক জোবায়ের মিয়া তার জমির ধান দেখিয়ে বলেন, ‘ব্রি ২৮ এবার আমাদের সঙ্গে বেইমানি করেছে। চিটায় ভরে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমার নিজের লোক নেই। শ্রমিক দিয়ে ৭৫ হাজার টাকা খরচ করে ১২ কিয়ার জমি চাষ করেছিলাম। সবই শেষ। এবার চাল কিনে খেতে হবে।’
নোয়াগাঁও গ্রামের অঞ্জু কর জানান, তার নিজের জমি নেই। ৭ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেছেন। মানুষের কাছ থেকে ঋণ করে এনে চাষ করেছেন। এখন পথে বসার উপক্রম। ইউছুপুর গ্রামের কৃষক শামীম মিয়া জানান, এমন ‘দুর্যোগ’ আসবে তারা ভাবতেও পারেননি। তিনি বলেন, পুরো ধানের ছড়ার প্রায় ৯০ ভাগ ধান চিটা। ১০ শতাংশ ভালো থাকলেও তা দিয়ে কাটানোর খরচ উঠবে না।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আবদুল লতিফ বলেন, ‘মূলত দুটি কারণে ব্রি ২৮ ধানের এই সমস্যা হতে পারে। প্রথমটি হলো ঠাণ্ডাজনিত এবং দ্বিতীয় হলো ব্লাস্ট রোগ। ব্রি ২৮ ধানের অনুমোদিত রোপণের সময় হলো নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ। তবে আমাদের দেশের অনেক কৃষক আগেই তা বপন করেন। ফলে ঠাণ্ডার কারণে ধান চিটা হয়ে যায়।’
আবদুল লতিফ আরও বলেন, ‘ব্লাস্ট ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগ হলে সাধারণত করার কিছু থাকে না। মূলত ধানের ফুল বা শিষ বের হওয়ার সময়েই এ ছত্রাক আক্রমণ করে। তাই প্রতিবছরই আবহাওয়া বুঝে আমরা কৃষকদের আগাম সতর্কবার্তা দিয়ে থাকি। এই বার্তা আমাদের ওয়েবসাইটের পাশাপাশি প্রতিটি জেলার দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে পৌঁছে যায়।’
এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘যারা ব্রি ২৮, ব্রি ৮১, ব্রি ৫০, ব্রি ৬৩ জাত চাষ করেন, তাদের সতর্ক থাকতে হয়। কারণ ব্লাস্ট রোগটি এসব জাতে বেশি দেখা দেয়। তবে আশার কথা হলো, আমরা খুব শিগগিরই হয়তো রোগ প্রতিরোধী ব্রি ২৮ জাতের বীজ কৃষকদের দিতে পারব।’
শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন জানান, শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ১১ হাজার ৪৫১ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। ব্রি ২৮ আবাদ হয়েছে দুই হাজার ৬৫১ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে অনেক জমির ধান ব্লাস্ট রোগ আক্রান্ত হয়েছে। যখন এটি প্রথম ধরা পড়ে, তখন পাতা একটু একটু মরতে শুরু করে। ওই সময় কৃষকদের দুই দফায় ছত্রাকনাশক স্প্রে করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। আর ইউরিয়ার পরিবর্তে ব্যবহার করতে বলা হয় পটাশিয়াম। অনেক কৃষক বিষয়টি আমলে না নিয়ে ছত্রাকনাশক স্পে করেননি। কেউ কেউ দিয়েছে একবার। কিন্তু যারা পরামর্শ পুরোপুরি মেনেছেন, তাদের ফসল নষ্ট হয়নি।
মহিউদ্দিন বলেন, ‘ব্রি ২৮ অনেক পুরনো একটি জাত। এটি এখন চাষ করতে কৃষকদের আমরা নিরুৎসাহিত করেছি। এর পরিবর্তে ব্রি ৮৮ ও ৮৯ চাষের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়।’
শ্রীমঙ্গল কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রকেন্দ্র শর্মা জানান, তাদের অনুসন্ধানে ১৬৮ বিঘা জমিতে ব্লাস্ট রোগের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। রোগের উপস্থিতি জানার পর তাৎক্ষণিক কৃষকদের নিরাময়ের পরামর্শ দেওয়া হয়। শেষমেশ ৫০ থেকে ৬০ বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়েছে।
মৌলভীবাজার জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা সামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, হাইল হাওর, কাউয়াদিঘি হাওর ও হাকালুকি হাওরের নিচু এলাকার প্রায় ৮ হেক্টর এলাকায় বি ২৮ জাতের ধান ও বি ৪৮ জাতের ধান নষ্ট হওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে। তবে এটি মূল উৎপাদনে কোনো প্রভাব ফেলবে না। তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করা হচ্ছে। সরকারের বরাদ্দ এলে তারা পাবেন।
একই চিত্র মোহনগঞ্জেও
মোহনগঞ্জ (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি জানান, ডিঙাপুতা হাওরে ব্রি-২৮ ধানে ব্লাস্ট রোগের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। স্থানীয় কৃষি বিভাগের হিসাব বলছে, ব্লাস্ট রোগে সংক্রমিত জমির পরিমাণ প্রায় ১২৫ একর।
ক্ষতিগ্রস্তরা কৃষকরা জানান, প্রথমে ধানের পাতায় ছোট ছোট ডিম্বাকৃতির সাদা বা বাদামি রঙের দাগ দেখা দেয়। পরে পুরো গাছে তা ছড়িয়ে পড়ে। সংক্রমণ বেশি হলে ধানের রং রোদে পুড়ে যাওয়ার মতো দেখায়। ধানের ভেতরে চাল থাকে না। শিষের গোড়ায় কালো ও বাদামি হয়ে যায়।
সিয়াধার গ্রামের কৃষক কামাল মিয়া ও মোফাজ্জল মিয়া জানান, তারা এবার ৬৪ কাঠা জমিতে ব্রি-২৮ ধান আবাদ করেছেন। ধানের ভেতরে কোনো চাল নেই। কয়েক দিন আগেও সব ভালো ছিল। দুই-তিন দিনে সব তছনছ হয়ে গেছে।
সিয়াধার গ্রামের কৃষক সুমন ভূঁইয়া জানান, হাওরে তার ৩২ কাঠা জমি আছে। তিনি ব্রি-২৮ ধান আবাদ করেছেন। ধানে ব্লাস্টের আক্রমণ হয়েছে। এতে করে এবার ধানের উৎপাদন কম হবে।
উপজেলা উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী কর্র্মকতা মো. দুলা মিয়া জানান, ১২৫ একর জমিতে ব্লাস্ট রোগের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। আগাম চাষাবাদে এবং দিনে গরম ও রাতে ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয়।