গত পাঁচ দশকে দেশ অনেক এগিয়েছে মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য ও পুষ্টি চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে । প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় কমিউনিটি ক্লিনিককে বিশ্বের মডেল দাবি করে সরকার। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দও বাড়ছে প্রতি বছর। তারপরও সেবার মান এখনো সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেনি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, স্থানীয় পর্যায়ে চিকিৎসাব্যবস্থা শক্তিশালী না করা, পর্যাপ্ত জনবলের অভাব, ‘রেফারেল সিস্টেম’ চালু না থাকা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর অব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে মানুষের মধ্যে হতাশা ও আস্থাহীনতা বাড়ছে।
পঞ্চাশোর্ধ্ব আবদুল কাইয়ুমের বাড়ি মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায়। শুরুতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, পরে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন তিনি। কিন্তু লাভ হয়নি। শেষমেশ আসতে হয়েছে রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালে। গত তিন দিন ধরে সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।
কাইয়ুমের স্ত্রী রিনা আক্তার আমাদের সময়কে বলেন, ‘উপজেলা হাসপাতালে গেলে কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেয়। কিন্তু সমস্যা ধরতে না পারায় পরে বেসরকারি হাসপাতালে নিই। বেশকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও উন্নতি না হওয়ায় এক আত্মীয়ের পরামর্শে এখানে এসেছি। কয়েকটি পরীক্ষা হাসপাতালে হলেও বাকিগুলো করতে হয়েছে বেসরকারিতে। এরই মধ্যে ৩০ হাজার টাকা চলে গেছে চিকিৎসার পেছনে।’
শুধু কাইয়ুম নন, স্থানীয় পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে না পারায় সীমিত আয়ের বহু মানুষ প্রতিদিন ঢাকার বাইরে থেকে আসছেন উন্নত চিকিৎসার আশায়। কিন্তু ব্যয় মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
এমন অবস্থায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ শুক্রবার বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মুজাহেরুল হক আমাদের সময়কে বলেন, ‘স্বাস্থ্যেসেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে বাংলাদেশ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর চেয়েও এগিয়ে। ইউনিয়ন স্বাস্থকেন্দ্র, উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক ও উপজেলা হাসপাতাল প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে প্রধান হাতিয়ার হওয়ার কথা। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতায় এগুলো ঠিকমতো কার্যকর হচ্ছে না। জনবল ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এমনিতেই পদ কম, আবার পদ অনুযায়ী লোকবল নেই। সংকট নার্স ও প্যারামেডিক্সের। এতে করে প্রকৃত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ। তৈরি হচ্ছে হতাশা এবং অনাস্থা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দরিদ্র ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী। এ জন্য স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবাকে সবার আগে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পাশাপাশি রেফারেল সিস্টেম চালু করা জরুরি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের গবেষণা বলছে, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার হার আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে সেবার মান কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নয়। চিকিৎসা ব্যয়ের সিংহভাগই ব্যক্তির নিজস্ব। ওষুধের পাশাপাশি বেশির ভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হয় বাইরে।
অন্যদিকে সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট বলছে, দুই দশকে দেশে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বেড়েছে ১২ গুণ। যতটা বরাদ্দ হচ্ছে, তার যথেষ্ট ব্যবহার করতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। চিকিৎসা সরঞ্জাম ও জনবল নিয়োগের পরও দেশের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী মানসম্পন্ন সেবা দেওয়া যাচ্ছে না, যা স্বাস্থ্য খাতের বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যক্তির ওপর চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ কমাতে হবে। এ জন্য ২০১২ সালে (২০১২ থেকে ২০৩১ সাল মেয়াদি) একটি কৌশলপত্র তৈরি করে সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট। এতে বলা হয়, ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যয় কমিয়ে ২০৩২ সালে ৩২ শতাংশে আনা হবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উল্টো। ওই সময়ে ব্যক্তির ব্যয় যেখানে ছিল ৬৪ শতাংশ, বর্তমানে তা প্রায় ৬৯ শতাংশ।
সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ তুলনামূলক কম। তারপরও মাত্র ১৪ দশমিক ৪১ শতাংশ মানুষ সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা নেন। বাকিরা যাচ্ছেন বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২০ সালে দেশে স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয় ছিল (সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে) প্রায় ৭৭ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু ওষুধ ও স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কিনতে ব্যয় হয় ৩৬ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ছিল ৫৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। আবার এর মধ্যে শুধু ওষুধ কিনতেই ব্যয় ৩৪ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যক্তির ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয় হয়েছে ওষুধের পেছনে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ শাহাদত হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘আগের তুলনায় এখন সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। অবকাঠামো হচ্ছে, নতুন করে যন্ত্রপাতি যুক্ত হচ্ছে। তারপরও ব্যক্তির খরচ এখনো কিছুটা বেশি। এটি কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে, তবে সময় লাগবে। যে গতিতে এগোচ্ছে, আশা করা যায় আস্তে আস্তে কমে আসবে।’
এদিকে ঠিকমতো চিকিৎসা না পাওয়া, চিকিৎসকদের বৈষম্যমূলক আচরণে চিকিৎসকদের প্রতি নেতিবাচক ধারণা বাড়ছে সাধারণ মানুষের। গবেষণা বলছে, দেশের ৮৪ শতাংশ মানুষ চিকিৎসকদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। সেবা পেয়ে সন্তুষ্ট নন ৮৫ শতাংশ মানুষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে দিনে একজন চিকিৎসককে যদি ১০০ থেকে ১৫০ জন রোগী দেখতে হয়, স্বাভাবিকভাবেই তার পক্ষে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া সম্ভব নয়। রোগীর কী হয়েছে, কোথায় সমস্যা, কী কী কারণে জটিলতা হচ্ছে, তা ভালোভাবে শুনতে পারেন না চিকিৎসকরা। ফলে খুব সহজেই চিকিৎসকদের আস্থা হারাচ্ছে মানুষ।’
আবদুল হামিদ বলেন, ‘একজন ব্যক্তি উপজেলা পর্যায়ে যদি কাক্সিক্ষত সেবা পান, নিশ্চয়ই তিনি শখ করে জেলা সদর হাসপাতালে যাবেন না। আমাদের কাঠামো আছে, কিন্তু চিকিৎসার গুণগত মান নেই। স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে জনবলের তীব্র সংকট রয়েছে, সবার আগে এগুলো পুরোমাত্রায় সচল করতে হবে। একই সঙ্গে রেফারেল সিস্টেম চালু রাখতে হবে। এতে করে জেলা ও মেডিকেলে রোগী কমবে এবং ডাক্তারও সময় দিয়ে রোগী দেখতে পারবেন।’