মানুষের ঢল সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে গতকাল ভোর থেকেই ছিল । হাতে হাতে লাল-সবুজের পতাকা। দূর থেকে ভেসে আসছে স্বাধীনতার কালজয়ী গান- ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলবো না।’ গীতিকার গোবিন্দ হালদারের কালজয়ী এই গানের সুর ধরে জাতির সূর্য সন্তানদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জানাতে গতকাল জাতীয় স্মৃতিসৌধে জড়ো হয়েছিলেন তাদের উত্তরসূরিরা। উপলক্ষ ছিল মহান স্বাধীনতা দিবস।

গতকাল দিনের প্রথম প্রহরে ভোর ৫টা ৫৬ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শুরু হয় রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা। এরপর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর একটি চৌকস দল রাষ্ট্রীয় সালাম জানায়। বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। উত্তোলন করা হয় জাতীয় পতাকা। পরে আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা দলীয় নেতাদের সঙ্গে জাতীয় স্মৃতিসৌধের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে স্মৃতিসৌধের পরিদর্শন বইয়ে সই করেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী।

এ সময় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, সভাপতিম-লীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিম-লীর সদস্য শাজাহান খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, কামরুল ইসলাম ও ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক

ড. হাছান মাহমুদ, মাহবুব উল আলম হানিফ ও আ ফ ম বাবাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, বিএম মোজাম্মেল হক, এসএম কামাল হোসেন, মির্জা আজম, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, আফজাল হোসেন, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়–য়া, উপ-দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

পরে একে একে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জাতীয় সংসদের স্পিকার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, তিন বাহিনীর প্রধান, মুক্তিযোদ্ধাসহ বিদেশি কূটনীতিক এবং উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা।

সেখানে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বিএনপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘গণহত্যা নিয়ে পাকিস্তানের ভাবধারায় কথা বলছে বিএনপি। পাকিস্তান যা বলে তারাও (বিএনপি) তাই বলে। কারণ তারা পাকিস্তানি ভাবধারায় উজ্জীবিত, তাদের হৃদয়ে পাকিস্তানি চেতনা। তারা এমনটা বলবে- এটাই সমীচীন।’

মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে সকাল ৯টার দিকে স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে বিএনপি। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ফখরুল বলেন, ‘ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম চলবে। ভোটের অধিকার, কথা বলার অধিকার ও সাংবাদিকদের সত্য লেখার অধিকার হারিয়ে গেছে। স্বাধীনতার এই মহান দিনে আমরা শপথ গ্রহণ করছি- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষ থেকে ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম চলবে।’

সকাল সাড়ে ৮টার দিকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সিপিবি সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স গণমাধ্যকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের ভাষ্য, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক ও প্রবাসীরা দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে গেছে। দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এখনো আমরা গণতন্ত্রহীনতা, সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করতে পারিনি। লুটপাটতন্ত্র এখন জেঁকে বসেছে। দেশের সম্পদ অনবরত পাচার হচ্ছে। এ সময় সিপিবির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।

জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও খুলনা বিভাগীয় অতিরিক্ত মহাসচিব মো. সাহিদুর রহমান টেপা সাভার স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এর পরপরই জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন তারা। এ সময় দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

রাজধানীর কল্যাণপুর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নাতি রেজওয়ান হাফিজকে সঙ্গে নিয়ে শহীদ সহযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে স্মৃতিসৌধে এসেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল হোসেন। অজস্র মানুষের ভিড় ঠেলে স্মৃতিসৌধের বেদির কাছে পৌঁছতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল শারীরিকভাবে অসুস্থ এই বীর মুক্তিযোদ্ধার। তবুও অদম্য এক শক্তিতে স্মৃতিসৌধের শহীদ বেদির সামনে গিয়ে কিছুটা সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আক্ষেপ ঝরে স্বাধীনতার এই বীর সেনানীর। জানান, ‘স্বাধীনতার ৫৩ বছর বয়সেও দেশে মুক্তিযুদ্ধের তালিকা নির্ভুলভাবে না হওয়াটা কষ্টের এবং বেদনার। আমরা তো এমন বাংলাদেশ চাইনি।’

গাজীপুর থেকে আসা বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে উন্নতি করেছে। অবকাঠামো উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষের মানবিক উন্নতিটা সেভাবে হয়নি, এটা হতাশার।

রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে মেয়ে তাবাসসুম সুলতানাকে নিয়ে স্মৃতিসৌধ এসেছিলেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মী সুলতানা রহমান রেবেকা। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার চেতনা প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতেই মেয়েকে সঙ্গে করে স্মৃতিসৌধে এসেছি।’

‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ মহান মুক্তিযুদ্ধের কালজয়ী এই স্লোগানে মুখর ছিল গোটা স্মৃতিসৌধ। সময় গড়াতে থাকে আর ফুলে ফুলে ভরে উঠতে থাকে স্মৃতিসৌধের শহীদ বেদি। জাতির বিনম্র শ্রদ্ধা ভালোবাসায় স্মরণ করা হয় স্বাধীনতা এনে দেওয়া জাতির সূর্যসন্তানদের। সবার কণ্ঠে ছিল, ক্ষুধা, দুর্নীতি ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার দীপ্ত শপথ। স্বাধীনতা দিবস ঘিরে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ছিল চার স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

বিকালে কেক কাটা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হয় বঙ্গভবনে। কেক কাটেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের সহধর্মিণী এবং ২২তম রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও তার সহধর্মিণী উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে দুপুরে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে শোভাযাত্রা ও সমাবেশ হয়। এরপর তারা ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ আবদুল আহাদ চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচন প্রস্তুতি কমিটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান কেএম মোজাম্মেল হক, কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল বাহার মজুমদার টিপু প্রমুখ।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031