আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো অব্যাহতি দেওয়ার নজিরও আছে। অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েও অনেক সময় ‘পিছু হটে’ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আবার মামলা হলেও ‘ফাইনাল রিপোর্ট’ জমা না দেওয়ার অভিযোগও আছে কমিশনের বিরুদ্ধে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের অভিযোগ সত্য হলে দুদকের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অন্যদিকে দুদকের ভাষ্য, কাউকে ছাড় দিলে তা যৌক্তিক কারণেই দেওয়া হয়। কারও পরামর্শ, মতামত বা ভয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়োগে দুর্নীতি, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) আরিচা নদী বন্দরে দুটি ঘাট ইজারায় দুর্নীতি, কক্সবাজার পানি শোধনাগার নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতি, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি থেকে অবৈধভাবে ২২টি আবাসিক খাতে গ্যাস সংযোগের

দুর্নীতির অভিযোগের সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছিল দুদক। কিন্তু আইনের বাইরে গিয়ে ‘ছোটখাটো অজুহাত’ দেখিয়ে এসব তদন্ত থেকে তারা ফিরে এসেছে। এ ছাড়া কোনো ক্ষেত্রে জড়িত ব্যক্তিকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়েছে।

এসব ঘটনা তুলে ধরলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, ‘তদন্তে আমলযোগ্য অভিযোগ থাকার পরও মামলা না হলে দেখতে হবে যে এর পেছনে দুদকের আইনি যুক্তি আছে কিনা?’

ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অফিস সহায়ক, নিরাপত্তা প্রহরী ও পরিচ্ছন্নকর্মী নিয়োগে দুর্নীতির একটি অভিযোগ ২০১৯ সালে আসে দুদকে। পরে দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৭ সালের ২৮ নভেম্বর এ নিয়োগ সংক্রান্ত কমিটি গঠন করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক খলিলুর রহমান। তার বদলির পর ২০১৮ সালে নতুন জেলা প্রশাসক হিসেবে আসেন সুভাষচন্দ্র বিশ^াস। এরপর তার নির্দেশে একই বছরের ৭ থেকে ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। এরপর ২৪ ডিসেম্বর নিয়োগ কমিটি ৩৯ জনকে নিয়োগপত্র দেওয়ার সুপারিশ করে। একই দিন জেলা প্রশাসক সুভাষচন্দ্র বিশ^াস অনুমোদন করে নিয়োগপত্রগুলো ইস্যু করেন। নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে ১৭ জনের বয়স বেশি ছিল। দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়োগ কমিটি অসৎ উদ্দেশ্যে ওই ১৭ জনের মৌখিক পরীক্ষার সময় জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করেনি এবং বাহ্যিকদৃষ্টে বয়স ৩০ বছরের বেশি অনুমিত হলেও তা আমলে নেয়নি।

এ ঘটনায় জেলা প্রশাসক সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস (বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শেখ মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) এম রকিবুল হাসানসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশ করেছিলেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও দুদকের সহকারী পরিচালক সাধনচন্দ্র সূত্রধর। কিন্তু সেই সুপারিশ গ্রহণ না করে দুদক অভিযোগটি নিষ্পত্তির মাধ্যমে পরিসমাপ্তি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দেয়। ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর দুদকের তৎকালীন সচিব মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের স্বাক্ষরে অভিযোগ নিষ্পত্তির বিষয়টি উল্লেখ করা হলেও তাতে কোনো কারণ লেখা হয়নি।

গত বছরের শুরুতে বিআইডব্লিউটিএর আরিচা নদী বন্দরে দুটি ঘাট ইজারায় অনিয়ম-দুর্নীতি অভিযোগ আসে দুদকে। অভিযোগটি অনুসন্ধান করে ঘাট দুটি কম মূল্যে ইজারা দিয়ে ছয় কোটি ৮০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করার প্রমাণ পান অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. আলিয়াজ হোসেন। এরপর গত বছরের মাঝামাঝিতে বিআইডব্লিউটিএর তৎকালীন চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেকসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন দেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা।

এরপর গত সেপ্টেম্বরে নৌবাহিনীর কর্মকর্তা গোলাম সাদেকসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে দুদক কর্মকর্তা আলিয়াজ হোসেনকে মামলা করার অনুমোদন দেয় দুদক। এতে বিআইডব্লিউটিএর তৎকালীন চেয়ারম্যান ছাড়াও সংস্থাটির কয়েকজন জড়িত ছিলেন।

দুদক থেকে মামলার অনুমোদনের পর বিআইডব্লিউটিএর তৎকালীন চেয়ারম্যান গোলাম সাদেক বলেছিলেন, মামলার বিষয়টি তিনি ‘সাংবাদিকদের মাধ্যমে’ জানতে পেরেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘সরকার থেকে আইন দ্বারা কিছু দায়িত্ব দেওয়া আছে, আমরা আইন, বিধি ও নীতিমালা মেনে বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুসারে সব কিছু পরিচালনা করে থাকি। আইনি দিক দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।’

এরপর পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও এ মামলা দায়ের করেনি দুদক। দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর সে মামলাটি যাতে ফাইল না হয়, সে বিষয়ে প্রভাবশালীদের থেকে দুদকের ওপর চাপ আসে। পরে দুদক মামলা না করে নীরব ভূমিকা পালন করছে।

২০২০ সালে দুদকে কক্সবাজার পানি শোধনাগার নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতি সংক্রান্ত একটি অভিযোগ আসে। এ অভিযোগ অনুসন্ধানের দায়িত্ব পান দুদকের চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন। অনুসন্ধানে ৩৬ কোটি টাকার দুর্নীতির প্রমাণ মেলে। অনুসন্ধান কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান, তার ছেলে, স্ত্রী, স্ত্রীর বড় ভাই ছাড়াও তৎকালীন জেলা প্রশাসক কামাল হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করেছিলেন। তবে সেই অনুসন্ধান প্রতিবেদন গ্রহণ করেনি দুদক।

এর পর শরীফকে চাকরিচ্যুত করে দুদক। পরে শরীফ অভিযোগ করেছিলেন, বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে ‘প্রভাবশালীদের’ বিরুদ্ধে মামলা করায় চাকরি হারাতে হয়েছে তাকে।

এরপর পানি শোধনাগারের দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব পান প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নূরজাহান পারভীনকে এবং উপপরিচালক আলী আকবর। এর মধ্যে গত ১২ মে আলী আকবর তার প্রতিবেদনে মেয়র মুজিবুর রহমান, জেলা প্রশাসক কামাল হোসেনসহ ৩৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সুপারিশ করেন। কিন্তু তার প্রতিবেদনও গ্রহণ করেনি দুদক। পরে আলী আকবরকে বাদ দিয়ে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় উপপরিচালক মো. সিরাজুল হককে।

ঘুষের বিনিময়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়ার বিষয়ে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে দুদকে একটি অভিযোগ আসে। অভিযোগ অনুসন্ধানের দায়িত্ব পান দুদকের তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন। অনুসন্ধানে অভিযোগের প্রমাণও পান তিনি।

অনুসন্ধানে উঠে আসে, নীতিমালা অমান্য করে মো. মুজিবুর রহমান নামের এক গ্রাহককে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়। মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির ছেলে। এরপর মুজিবুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সুপারিশ করে ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে কমিশনে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। পরে ২২টি অবৈধ গ্যাস সংযোগের ঘটনায় একই বছরের ১০ জুন কেজিডিসিএলের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক (ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস) প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন, সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, সাবেক ব্যবস্থাপক মো. মজিবুর রহমান, বিক্রয় বিভাগের টেকনিশিয়ান সি-গ্রেড মো. দিদারুল আলম ও গ্রাহক মুজিবুর রহমানকে আসামি করে মামলা হয়।

এ মামলার তিন দিনের মধ্যে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার সানোয়ারা আবাসিক এলাকার ওই ২২টি অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নও করে কেজিডিসিএল। এর মধ্যে এ মামলায় তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করে দুদক।

শুরুতে মামলার বাদী শরীফ এ তদন্ত করলেও গত বছর নতুন করে তদন্তের দায়িত্ব পান সংস্থাটির চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয় ২-এর উপপরিচালক মো. আতিকুল আলম। তিনি কমিশনে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। পরে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি এ মামলা থেকে সবাইকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় দুদক।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এসব তদন্তে মেরিটের কোনো উপাদান আছে কিনা, নাকি ব্যক্তির পরিচয় বা অবস্থানের ওপর নির্ভর করে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে- এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ব্যক্তি সরকারি কর্মকর্তা বা দায়িত্বশীল অবস্থানের কারণে বা রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ার কারণে যথাযথ সিদ্ধান্ত না হয়ে থাকলে ধরে নিতে হবে, আইনের চোখে যে সবাই সমান, সেটা দুদক বিবেচনায় নিচ্ছে না।’

প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বে¡ও অভিযুক্তদের ছাড় দেওয়ার বিষয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘আমরা যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি, তা হলে পরে প্রয়োজনে এর রিভিউ আমরা করতেই পারি। সেটা নিয়ে নিজেরা পর্যালোচনা করে দেখতে পারি সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কিনা। যদি পর্যালোচনায় মনে হয় ছোটখাটো ভুল হয়েছে, তা হলে এর সংশোধনের সুযোগ আছে। এমনকি চার্জশিট দাখিলের পর আদালতেও সুযোগ থাকে।’

তিনি বলেন, ‘কোনো বিষয়ে সংশোধনের ব্যবস্থা নেওয়া মানে এই নয় যে, আমরা পিছু হটেছি বা ফেরত গিয়েছি। মামলা অবশ্যই হবে, তবে দু-একটা পরিবর্তন আসতে পারে। সেটা অধিকতর পরীক্ষা করা হবে। দুদক কাউকে ছেড়ে দিলে যৌক্তিক কারণেই ছাড়বে। এটা কারও পরামর্শে, মতামতে বা ভয়ে করবে বলে আমি মনে করি না। আমরা আইনকে অনুসরণ করব।’

 ‘আমার মনে হয় এমন বিষয় নেই চার্জশিট অনুমোদনের ক্ষেত্রে একই নাম বারবার এলেও তা ফেরত দেওয়া হচ্ছে- এমন অভিযোগের বিষয়ে কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন। কোনো তদন্তের প্রতিবেদন দেখে যদি মনে হয় যে বিষয়টি এমন হওয়ার কথা নয়, তখন যাচাই করার জন্য কর্মকর্তা পরিবর্তন করি। এটা কেবল যাচাই করার জন্য। কাউকে বাঁচানো বা কাউকে ধরা- এমন উদ্দেশ্যে তা করা হয় না।’

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031