বৈধভাবে ছাড়াও পর্যটন ভিসা নিয়ে এসে বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করে গোপনে তারা বাংলাদেশ থেকে হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা থামছেই না। অথচ এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ ছাড়া বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিদের চিহ্নিত করা, তাদের প্রকৃত আয় ও নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ফলে প্রকৃত আয়কর আদায়ও করতে পারছে না এনবিআর। এমন প্রেক্ষাপটে কর ফাঁকিদাতা বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে জেল-জরিমানাসহ কঠোর পদক্ষেপ নিতে চায় সংস্থাটি।
আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ধারা ১৬ (বি) অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) প্রাক অনুমোদন ছাড়া অবৈধভাবে বিদেশি নাগরিকদের কর্মে নিয়োজিত করলে আয়কর আইনে উক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ৫ লাখ টাকা বা প্রদেয় আয়করের ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত আয়কর আরোপ করার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া একই অধ্যাদেশের ধারা ১৬৫ (সি) মোতাবেক ৩ বছর পর্যন্ত জেল এবং ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা ধার্য করারও বিধান রয়েছে। এনবিআর উপরোক্ত অধ্যাদেশের কথা স্মরণ করে দিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর এবং প্রকল্পে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের ভিসা ক্যাটাগরি পুনঃনিরীক্ষার অনুরোধ করেছে।
কোনো বিদেশি নাগরিক ইতোমধ্যে যথাযথভাবে নিবন্ধিত না হয়ে থাকলে তাদের নিবন্ধনের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও চিঠিতে অনুরোধ জানিয়েছে এনবিআর।
এনবিআরের ট্যাক্সেস লিগ্যাল অ্যান্ড এনফোর্সমেন্টের সদস্য মো. মাহমুদুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন উৎস থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের অনেকেই বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) এবং এতদুদ্দেশ্যে সরকার নিয়োজিত উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের প্রাক অনুমতি ছাড়া বিভিন্ন ক্যাটাগরির ভিসা (ট্যুরিস্ট, বিজনেস, ভিসা অন অ্যারাইভাল, স্টুডেন্ট, ব্লাঙ্ক) নিয়ে কর্মরত রয়েছেন এবং আয়কর নেটের বাইরে রয়েছেন।
বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের বিষয়ে এনবিআরের পাঠানো চিঠির বিষয়ে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জানা গেছে, বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকদের নিয়োগ ও চাকরি করার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাব রয়েছে। নীতিমালা বাস্তবায়নে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষও নেই। ফলে বিদেশিরা যেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, সেখানে তাদের প্রকৃত বেতন গোপন করা হচ্ছে। এ ছাড়া একজন বিদেশি নাগরিক সিইও হিসেবে প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার ডলার বেতন পেলেও কাগজপত্রে সেটি দেখানো হচ্ছে মাত্র তিন থেকে চার হাজার ডলার। দেশে বিদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্তৃপক্ষও নেই। ফলে বিদেশি কর্মীদের আসা-যাওয়ায় নজরদারি রাখা, নিয়োগ প্রক্রিয়ার বৈধতা পরীক্ষা এবং অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভূত অর্থ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। আয়কর ফাঁকি দিতে বিদেশি নাগরিকদের নিয়োগ কর্তৃপক্ষ প্রকৃত বেতনের একটি অংশ বৈধভাবে দিলেও সিংহভাগই অবৈধভাবে নগদ দেওয়া হয়ে থাকে। আর অবৈধভাবে কাজ করা কর্মীদের পুরো বেতনই নগদ অথবা অন্য কোনো দেশের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেওয়া হয়ে থাকে। এ ছাড়া কর্মীদের হাতখরচ, আবাসন, পরিবহন ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হয়।
সম্প্রতি মানিলন্ডারিং-সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটির বৈঠকে বিদেশি নাগরিকদের অর্থ ও কর ফাঁকি, ভিসা ক্যাটাগরি পরিবর্তন করে অবৈধভাবে চাকরির বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বিদেশি নাগরিকরা কর দিচ্ছে না, অবৈধভাবে বিদেশে টাকা পাঠাচ্ছে এমন কয়েকটি ঘটনা শনাক্ত করে গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করতে হবে। পাশাপাশি এসব ঘটনার ব্যাপারে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থাও নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, আইন সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব, দুদকের চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, অ্যাটর্নি জেনারেল, বিএফআইইউ প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ওই বৈঠকে আরও বলা হয়, অনেক বিদেশি নাগরিক সাধারণত ভ্রমণ বা অন অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং পরবর্তী সময়ে কাজ করার অনুমতি না নিয়েই চাকরিতে যোগ দেন। অনেক ক্ষেত্রেই তারা যেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, সেখানের নথিপত্রে বিদেশি কর্মী উল্লেখ থাকে না। এদিকে নজর কম থাকায় সংশ্লিষ্ট এসব নাগরিকের কাছ থেকে আয়কর আদায় করা যাচ্ছে না।
সিআইডির পক্ষ থেকে বৈঠকে বলা হয়, কর ফাঁকিবাজ যেসব বিদেশি নাগরিক ভিসার ধরন পরিবর্তন করছেন, তাদের ধরতে ইতোমধ্যে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ বেশকিছু অভিযান চালিয়েছে। সেখানে অনেক বিদেশিকে শনাক্ত করে ফেরত পাঠানো হয়েছে নিজ নিজ দেশে। কিন্তু বিডার অনুমোদন ছাড়া কোনো বিদেশি নাগরিক কাজ করতে পারে না। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বয়ে বিষয়টি সমাধান করা সম্ভব।
বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকরা প্রতিবছর অবৈধভাবে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) বলছে।