জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রিতে সীমিত রাখা, উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে আজ রবিবার আফ্রিকার দেশ মিশরের সমুদ্রতীরবর্তী পর্যটন শহর শার্ম আল শেখে শুরু হচ্ছে ২৭তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন বা কপ-২৭। সম্মেলন চলবে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত। তবে সম্মেলনের সাফল্য নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ, ১০০টিরও অধিক দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানসহ প্রায় ২০০ দেশের প্রতিনিধি, বিজ্ঞানী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সাংবাদিক এ সম্মেলন উপলক্ষে শার্ম আল শেইখে জড়ো হয়েছেন।
কপ-২৭ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বৈশ্বিক পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি বাঁচা-মরার মুহূর্ত। আজ থেকে সম্মেলন শুরু হলেও এখানে আলোচ্য বিষয়বস্তুগুলো নিয়ে নেপথ্যে আলোচনা অনেক দিন ধরেই চলছে। পৃথিবী এ মুহূর্তে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে বজায় রাখার মতো অবস্থায় নেই। আর গত বছরের প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর পর এ বাস্তবতা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। কোভিড ১৯-এর ফলে সৃষ্ট চলমান অর্থনৈতিক মন্দা, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ এবং বিভিন্ন দুর্যোগে জলবায়ু পরিবর্তনের বাড়তি প্রভাবের ফলে জলবায়ুতে কার্বন নির্গমনের মাত্রা কমিয়ে আনা ও এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় বিশাল বাধার সৃষ্টি হয়েছে।
advertisement 3
যে দুই শতাধিক দেশের নেতা ও প্রতিনিধিরা সম্মেলনে উপস্থিত হবেন, তাদের কাছে জানতে চাওয়া হবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে কার্বন গ্যাস নির্গমন কমাতে কী করবেন? এখানে প্রতিটি দেশেরই স্বপ্রণোদিত জাতীয় পরিকল্পনা, যাকে বলা হচ্ছে ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন (এনডিসি) তুলে ধরার কথা।
advertisement 4
এদিকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা থেকে বাঁচাতে চার দাবিতে সোচ্চার থাকবে বাংলাদেশ। জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ এবং জলবায়ু ঝুঁকি ফোরামের (সিভিএফ) নেতৃত্বে রয়েছে ঢাকা। শার্ম আল শেইখে যে দাবি তুলে ধরা হবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে, সেগুলো হলো বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখা। প্রত্যেক দূষণকারী দেশকে অবশ্যই কার্যকর এনডিসি দিতে হবে। প্যারিস চুক্তিতে জলবায়ু তহবিলের জন্য উন্নত দেশগুলোর পূরণ করতে হবে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলারের অঙ্গীকার। সেই অর্থ সমানভাবে অভিযোজন ও প্রশমন কাজে লাগানো হবে। জলবায়ুর প্রভাবে যারা উদ্বাস্তু হচ্ছে, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে তাদের। আমরা অধিক পরিমাণে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও সবুজ প্রযুক্তি চাই। উন্নত দেশগুলোকে এ জন্য সহযোগিতা করতে হবে। লস অ্যান্ড ড্যামেজ এজেন্টার আলোকে নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র তহবিল তৈরি করা যায় কিনা সে চেষ্টা চালানো।
একই বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন বলেন, কপ-২৭ সম্মেলন নিয়ে আমরা আশাবাদী। আমরা এ সম্মেলন থেকে ভালো কিছু নিয়ে আসতে পারব। আমরা আশাবাদী যে, উন্নত দেশগুলো ১০০ বিলিয়ন ডলারের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে। আমরা সিভিএফের সমস্যাও তুলে ধরব।
গত বছর জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৬) অনুষ্ঠিত হয় স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে এবং শেষ হয় গ্লাসগো জলবায়ু ঐকমত্যের মধ্য দিয়ে। এর মধ্যে রয়েছে কয়লা বিদ্যুতের ব্যবহার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিসহ জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি বন্ধ করা। কপ ২৬-এ প্যারিস রুল বুকটিও চূড়ান্ত করা হয়, যা আর্টিকেল ৬ নামে পরিচিত, যার মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত হয়।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য কপ-২৬ ছিল একটি বড় হতাশার জায়গা। কারণ এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে স্থায়ী এবং অপরিবর্তনীয় ক্ষতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পাওয়া ত্বরান্বিত হবে বলে মনে করা হচ্ছিল। অথচ গত বছর এই ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতিই হয়নি। গ্লাসগো সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি এবং লস অ্যান্ড ড্যামেজ মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করলেও তা কাটিয়ে উঠতে আর্থিক সহায়তা প্রদান করার বিষয়ে কোনো সুষ্পষ্ট দিকনির্দেশনা ছাড়াই শেষ হয় সেবারের আসর।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যেমন খরা, অস্বাভাবিকভাবে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় এবং অন্যান্য বিপর্যয়, অনিয়মিত বৃষ্টির কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসন এবং বাস্তুচ্যুতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন একটি অঞ্চল হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া। দিন দিন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো কেবল আরও গুরুতর এবং আরও তীব্র হয়ে উঠছে। শুধু ২০২২ সালেই একাধিক চরম ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ায় আঘাত করেছে। এই বছরের শুরুর দিকে ব্যাপক বন্যা বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের লক্ষাধিক মানুষের জীবন-জীবিকাকে বাস্তুচ্যুত ও ধ্বংস করে। পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যা কমপক্ষে ৩৩ মিলিয়ন মানুষকে প্রভাবিত করেছে এবং এতে কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়।
এদিকে জাতিসংঘের নতুন একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসে বিশ্বের দেশগুলোর সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী উষ্ণায়ন কমানোয় একেবারেই যথেষ্ট অগ্রগতি না হওয়ায় এ শতাব্দীতে তাপমাত্রা গড়ে ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়ার মুখোমুখি হয়েছে বিশ্ব। তাপমাত্রায় জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব পড়েছে, সেটি খতিয়ে দেখে গবেষণায় বলা হয়েছে বর্তমানে বিশ্বের দেশগুলো যে জলবায়ু নীতি অনুসরণ করছে, তাতে এ শতাব্দীতে উষ্ণায়ন ওই পরিমাণ বেড়ে যাবে।
গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনের পর থেকে বিশ্বের দেশগুলোর সরকারের কার্বন নিঃসরণ কমানোর পরিকল্পনায় দুঃখজনকভাবে পর্যাপ্ত অগ্রগতি হয়নি। এ পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে সমাজে রূপান্তর ঘটানো গেলেই কেবল বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। বৃহস্পতিবার এ বার্ষিক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি)। এতে বলা হয়েছে, তাপমাত্রা বেঁধে দেওয়া সীমা (১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এখন ভেস্তে যাওয়ায় মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে। গত জলবায়ু সম্মেলনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মোতাবেক নতুন করে কার্বন নিঃসরণ কমানোর যে চেষ্টা শুরু হয়েছে, তাতে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমবে ১ শতাংশেরও কম। অথচ বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখতে হলে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ ৪৫ শতাংশ কমা দরকার। তাই বর্তমানে বিভিন্ন দেশের সরকারের যে জলবায়ু পরিকল্পনা আছে, তাতে আরও গতি সঞ্চার না করা গেলে এ শতাব্দীর শেষ নাগাদই তাপমাত্রা ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে, যা গত বছরের আনুমানিক হিসাবের চেয়ে শূন্য দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। বিশ্বের দেশগুলো আর্থিক সহায়তা পেলে এবং পরিকল্পনামাফিক কাজ করলে তাপমাত্রা ২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখা যেতে পারে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এ সপ্তাহে বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিশ্বকে আবার জলবায়ু পরিবর্তনের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে, নতুবা বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে।