ঢেঁকি গ্রাম বাংলার প্রতিটি গৃহস্থের বাড়িতে একসময়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল । এটি নিয়ে রচিত গান ও প্রবাদ এখনো প্রচলিত। বর্তমান যান্ত্রিক যুগে পা দিয়ে চালিত এ যন্ত্রটি এখন বিলুপ্তির পথে। দেশের অধিকাংশ জায়গায় ঢেঁকিতে ধান ভানার দৃশ্য খুব একটা চোখে পড়ে না। শোনা যায় না এর ধুপধাপ আওয়াজ। কিন্তু ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার কাশিমপুর ইউনিয়নের দুএকটি গ্রামে দেখা মিলেছে গ্রামীণ এই ঐহিত্যটি। বনবাংলা গ্রামের গৃহবধূ উম্মে কুলসুম ও কুড়িপাড়া গ্রামের গৃহবধূ জলিলা বেগমের বাড়িতে শোনা গেছে ঢেঁকির ধুপধাপ শব্দ। দুজনই বিয়ের উপটৌকন হিসেবে বাবার বাড়ি থেকে পেয়েছিলেন ঢেঁকি দুটি। ষাটোর্ধ্ব এই দুই বৃদ্ধার বিয়ের বয়স ৪৫ পেরিয়ে গেলেও স্মৃতি হিসেবে এখনো তারা আগলে রেখেছেন সেই ঢেঁকি।
স্মৃতিচারণ করে গৃহবধূ উম্মে কুলসুম বলেন, এক সময় এই ঢেঁকির ব্যাপক চাহিদা ছিলো। প্রায় প্রতিটি গৃহস্থের বাড়িতেই ছিল ঢেঁকি। দেশ স্বাধীনের আগে বাবা নিজে বসে থেকে কারিগর দিয়ে দামী কাঠ দিয়ে বানিয়েছিলেন এই ঢেঁকি। বানানোর সময় কারিগরদের বাবা বলতেন, মেয়ের বিয়ের উপটৌকন হিসেবে পাঠাবো এই ঢেঁকি। ভালো করে বানাও যেন নষ্ট না হয়। মানকোন ইউনিয়নের বেজবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা উম্মে কুলসুমের বাবা হাসেন আলী আজ আর জীবিত নেই। বাবার স্মৃতি ঢেঁকিটি আজও আগলে রেখেছেন কুলসুম।
জানা যায়, এক সময় ধান ভানা বা শস্য কোটার জন্য ব্যবহৃত হতো ঢেঁকি। জানা যায়, সুদূর অতীত থেকে ময়মনসিংহ তথা ভারত উপমহাদেশে ঢেঁকি ব্যবহার হয়ে আসছে।
এক খ- পাথরের চটান বা কাঠ খ-ে গর্ত খুঁড়ে মুষলের সাহায্যে নির্মাণের পর তাতে শস্য কোটা হয়। মুষলটির মাথায় লোহার পাত জড়ানো থাকে। মুষলটি ৪/৫ হাত লম্বা একটি ভারী কাঠের আগায় জোড়া লাগিয়ে গর্ত বরাবর মাপে দুটি শক্ত খুঁটির উপর পুঁতে রাখা হয়। শস্য কোটার জন্য ঢেঁকির গর্তে শস্য ঢেলে দিয়ে এক জন বা দু’জন ঢেঁকির গোড়ায় ক্রমাগত চাপ দেয়। অন্যদিকে মুষলের আঘাতের ফাঁকে ফাঁকে আরেকজন গর্তের কাছে বসে শস্যগুলো নাড়াতে থাকে।
বনবাংলা ও কুড়িপাড়া গ্রামের ওই দুই ঢেঁকিতে আর এখন ধান কোটা হয় না। তবে পিঠা বানানোর জন্য চালের গুড়ো করতে এখনও ব্যাপক কদর রয়েছে তাদের ঢেঁকির। প্রায় প্রতিদিনই স্থানীয় বা দূরবর্তী এলাকা থেকে মহিলারা তাদের বাড়িতে চাল নিয়ে এসে উপস্থিত হন। ঘরের ভেতর থাকা ঢেঁকিতে চলে চাল কোটা।
মঙ্গলবার বনবাংলা উম্মে কুলসুমের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, ঢেঁকিতে পাশের গ্রামের এক নারী চালের গুড়ো করছেন। তিনি জানালেন, আমাদের বাড়ির কাছে কোনো ঢেঁকি নেই। তাই এই বাড়িতে এসেছি। অনেকটা পথ কষ্টে করে হাঁটতে হয়েছে ঠিকই কিন্তু তরপরওতো পাওয়া যাবে ঢেঁকিতে ভাঙা চালের গুড়োর পিঠার আসল স্বাদ।
ঢেঁকির মালিকরা জানান, মহিলারা ঢেঁকিতে আতপ চাল কুটে থাকেন । চার-পাঁচ হাত লম্বা ঢেঁকি। মহিলারা জানালেন, বাজার থেকে আতপ চাল কিনে এনে ওই চাল কোটার আগে আধ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর তা ঢেঁকিতে ফেলে কুটে নিতে হয়। ওই কোটা চাল নাইলনের নেটের মাধ্যমে ছেঁকে নিতে হয় পিঠা তৈরি করার আগে।
তারা জানান, ঢেঁকিতে কোটা চাল দিয়ে তৈরি পিঠার স্বাদই আলাদা। তাই পরিশ্রম সাপেক্ষ হলেও বিভিন্ন পার্বনে তারা ঢেঁকির উপরেই ভরসা রাখেন। ভোজন রসিক কিছু বাঙালি আজো স্বাদ ভাল হবে বলে এবং স্মৃতি সংরক্ষণে গ্রামবাংলায় কুলসুমদের ঘরে এ ভাবেই টিঁকে আছে ঢেঁকি। যদিও নতুন প্রজন্মের মাঝে সেই উৎসাহ নেই বাংলার নিজস্ব ঘরানার ঐতিহ্যের খাদ্য তৈরির এই প্রক্রিয়ায়।
ঢেঁকিতে চাল কোটার কাজ করতে করতে মহিলারা জানালেন, পালা পার্বনে শুরু হয়ে যায় পিঠা তৈরির কাজ। পার্বনে গ্রামবাংলায় বাড়িতে মহিলাদের পিঠে তৈরির উৎসব পালন করার চল এখনও রয়েছে। ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, মেরা পিঠা, কুলি পিঠা, চষি পিঠা, পাটিসাপটা ও পোয়াসহ কত না বাহারি নাম এসব পিঠার।
কুলসুম, জলিলা বেগম জানান এখনও প্রায় দিনই মহিলারা বাড়িতে এসে চাল কুটে নিয়ে যান। সেজন্য টাকা পয়সা নেন না তারা। শীতের মৌসুমে এবং পার্বনে তাদের বাড়িতে চাল কোটার দৃশ্য দৃষ্টি কাড়ে। সুদূর অতীতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পৌষ সংক্রান্তি এলে ঢেঁকিতে গোবর লেপে পূঁজা করতেন। পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে গ্রামের মহিলারা হিন্দু মহিলারা চালের গুঁড়ো দিয়ে আলপনা দিতেন। সন্ধ্যা নামতেই তারা হাত দিতেন পিঠা তৈরির কাজে। বাড়ি বাড়ি এ সময়ে তাদের আত্মীয়-স্বজনের ভিড় লেগে থাকতো।
যারা আজো ঢেঁকিতে চাল কুটো করেন তারা জানান, মেশিনে ভাঙ্গা চাল থেকে পিঠা বানালে পিঠা শক্ত হয়ে যায়। বেশিক্ষণ রেখে খাওয়া যায় না। তাই ঢেঁকিতে ছাঁটা চাল দিয়েই পিঠা বানাতে ভালবাসেন তারা। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও উপায় থাকে না সব সময়। ঢেঁকির দেখা ইদানীং তেমন মেলে না গ্রামবাংলায়। যদিও বা পাওয়া যায়, সেখানে ১ কেজি চাল কুটতে খরচ পড়ে যায় গোটা ২০ টাকা। যেখানে মেশিনে ভাঙাতে খরচ মাত্র ৫ টাকা।
ঐতিহ্য আর স্বাদের কদর করেন যারা, ঢেঁকির মূল্য বুঝবেন তারাই মনে করেন কুলসুম , জলিলা বেগম। যদিও নতুন প্রজন্মের কাজে ঢেঁকি এখন কল্প কাহিনী।