দেশের নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি আর নানা অব্যবস্থাপনায় দুরবস্থা বিরাজ করছে । আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারের লুটপাটের শিকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে পুরো খাতই আস্থার সংকটে পড়েছে। এতে উচ্চ সুদেও অনেক প্রতিষ্ঠান আমানতের দেখা পাচ্ছে না। বিদ্যমান আমানতের টাকাও তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। ক্রমশ কমে যাচ্ছে আমানত। অন্যদিকে লাগামহীন বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এ কারণে হাতেগোনা কয়েকটি বাদে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই রয়েছে তারল্য সংকটে। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে, আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না কেউ কেউ।
এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মাইডাস ফাইন্যান্সিং নামে আরেকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির আমানতকারী ও বিনিয়োগকারীদের আশঙ্কা- এ প্রতিষ্ঠানটিও যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ফলে তারাও নিঃস্ব হয়ে পড়বেন। প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির তথ্য তুলে ধরতে আজ বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) সংবাদ সম্মেলন করার কথা রয়েছে ভুক্তভোগীদের। তবে এ বিষয়ে তাদের কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে রাজি হননি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এক ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পিপলস লিজিংসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও কর্মকর্তারা অনিয়ম, জালিয়াতি ও যোগসাজশের মাধ্যমে নামে-বেনামে ঋণ বের করে নেওয়ায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। এ থেকে উত্তরণে আর্থিক খাত সংস্কারের পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিতে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার তদরকি জোরদারের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বর্তমানে দেশে ৩৪টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালু আছে। এর মধ্যে তিনটি সরকারি, ১২টি দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানায় এবং বাকিগুলো দেশীয় ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত। এর মধ্যে অন্তত ১০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা এখন নাজুক। এসব প্রতিষ্ঠানের বিতরণ করা ঋণের ৩০ থেকে ৯৭ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, এটা আর্থিক খাতের বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা, সমস্যা ও নতুন নতুন যেসব চ্যালেঞ্জ আসছে তারই প্রতিফলন। ব্যাংকের ক্ষেত্রে যেমন খেলাপিরা টাকা ফেরত না দিলেও তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না; আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও একই আচরণ দেখা যাচ্ছে। এখানেও পরিচালক ও কর্মকর্তারা যোগসাজশে নামে-বেনামে ঋণের টাকা তছরুপ করে পালিয়ে গেছেন। ফলে এ খাতের প্রতি মানুষের অবিশ্বাস ও সন্দেহ বেড়েছে। টাকা রাখলে ফেরত পাওয়া যাবে কিনা এই ভয় ঢুকে গেছে। এর মধ্যেই আমানতের সুদে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ক্যাপ দেওয়ায় গ্রাহকরা আরও নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছেন। আমানত কমে যাওয়ার এটিই বড় কারণ। সার্বিকভাবে আর্থিক খাতে সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করা না গেলে এ খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা কঠিন হবে বলেও মন্তব্য করেন সাবেক এই গভর্নর।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সর্বনিম্ন তিন মাস
মেয়াদের আমানত জমা নিতে পারে। এর বাইরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতের অন্যতম উৎস ব্যাংক। কিন্তু আস্থা সংকটে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই ৬ মাসে আমানত কমেছে ৪১৯ কোটি টাকা। গত জুন শেষে খাতে আমানত দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৮৬ কোটি টাকা। যা গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ৪২ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশন (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান ও আইপিডিসি ফাইন্যান্সের এমডি মমিনুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, এ খাতে আমানত কমে যাওয়ার মূল কারণ সুদে সীমা আরোপ। তবে সব প্রতিষ্ঠানের আমানত কমে নাই। এটাও ঠিক, খারাপ প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে তাদের কাছ থেকে মানুষজন আমানত তুলে নিচ্ছেন। আবার ব্যাংকও তাদের আমানত ও ঋণগুলো ফেরত নিতে সচেষ্ট হয়েছে। এটা প্রতিষ্ঠানগুলোর তারল্যে আরও আঘাত করেছে। এ খাতের প্রতি মানুষের আস্থা আগের চেয়ে বাড়ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত মে মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য নিয়ে আমরা যে মেলার আয়োজন করেছিলাম, সেখানে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি মানুষজন এসেছেন এবং উৎসাহ দেখিয়েছেন। তবে আমরা সক্ষমতার জায়গা থেকে মানুষের আস্থার প্রতিদান দিতে পারছি না। এ খাতে রয়েছে তারল্য সংকট। এ সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল চেয়েছি। আমানতের সুদের ক্যাপ তুলে দেওয়ার অনুরোধ করেছি। এ ছাড়া দুর্বল ও সমস্যাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনেরও দাবি জানিয়েছি।
আমানত কমার পাশাপাশি বিতরণ করা ঋণের টাকাও যথাসময়ে ফেরত পাচ্ছে না আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে নানা সুবিধা দেওয়ার পরও এ খাতে লাগামহীন বাড়ছে খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৬৯ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা, যা এ খাতে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ২২ দশমিক ৯৯ শতাংশ। খেলাপি ঋণের এই হারও এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। তিন মাস আগে ২০২২ সালের মার্চে এনবিএফআইয়ের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ২৩২ কোটি টাকা বা ২০ দশমিক ৬৩ শতাংশ। তিন মাসের ব্যবধানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক হাজার ৭০৪ কোটি টাকা। আর ছয় মাসের ব্যবধানে বেড়েছে দুই হাজার ৯২০ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এ খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১৩ হাজার ১৬ কোটি টাকা।
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি পিকে হালদার নানা জালিয়াতির মাধ্যমে অন্তত চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেন। তার লোপাটের শিকার প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আর্থিক খাতের গলার কাঁটা। এর মধ্যে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসকে প্রথমে অবসায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরে পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অপর প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস (ফাস) ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) আর্থিক অবস্থা এখন চরম নাজুক। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিতরণ করা ঋণের ৭৬ থেকে ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত খেলাপি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থাও নাজুক। এর মধ্যে আছে ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স ও উত্তরা ফাইন্যান্স। খেলাপি ঋণ বাড়ছে এ ছাড়া আভিভা ফাইন্যান্স (সাবেক রিলায়েন্স ফাইন্যান্স) ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্যাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স (আইআইডিএফসি) কোম্পানিরও।