আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭৫ পেরিয়ে ৭৬-এ পা ফেললেন। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের মধুমতি নদীবিধৌত টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে যোগ দেওয়ার কারণে এবারের জন্মদিনে তিনি দেশের বাইরে রয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা তার জন্মদিন উদযাপনের বিষয়ে বিগত দিনেও দলের নেতাদের নিরুৎসাহিত করেছেন। কিন্তু দলের নেতারা তা মানতে নারাজ। তাই তার অনুপস্থিতিতেই দিনটি উৎসবমুখর পরিবেশে নানা কর্মসূচিতে উদযাপন করবে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ আজ বিকাল ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে আলোচনাসভা করবে। এ ছাড়া আজ বাদ জোহর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে হবে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল।

সকাল ১০টায় ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহারে (বাসাবো, সবুজবাগ) বৌদ্ধ সম্প্রদায়, সকাল ৯টায় খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (সিএবি) মিরপুর ব্যাপ্টিস্ট চার্চে (৩/৭/এ সেনপাড়া, পর্বতা, মিরপুর-১০) এবং বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায় বিশেষ প্রার্থনা সভার আয়োজন করেছে। এসব কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত থাকবেন।

দীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে শেখ হাসিনা আজ স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সভাপতি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও। ১৯৮১ সাল থেকে গত ৪১ বছর দলটির সভাপতি পদে আছেন তিনি। অন্যদিকে টানা তিনবারসহ মোট চার মেয়াদে প্রায় ১৯ বছর ধরে তিনি দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। তার নেতৃত্বে অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনেও তিনি বিশ্বনেতাদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতায় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে সারাবিশ্বে হয়েছেন প্রশংসিত।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে- ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বের কারণেই করোনা মহামারীর মধ্যেও দেশের অর্থনীতির চাকা সচল ছিল। এ কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এশিয়ার প্রায় সব দেশের ওপরে।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি, একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ সম্পন্ন করা, সংবিধান সংশোধনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি এবং সমুদ্রে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ব্লু ইকোনমির নতুন দিগন্ত উন্মোচন, ভারতের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন ও ছিটমহল বিনিময়, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট সফল উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে মহাকাশ জয় করার মতো অনেক অনেক সাফল্য রয়েছে শেখ হাসিনার।

সাবমেরিন যুগে বাংলাদেশের প্রবেশ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন নতুন উড়াল সেতু, মহাসড়কগুলো ফোর লেনে উন্নীত করা, এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭৪ বছর ৪ মাসে উন্নীতকরণ, যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন, সাক্ষরতার হার ৭৫ শতাংশে নেওয়া, বছরের প্রথম দিনে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে নতুন বই পৌঁছে দেওয়া, মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারার শিক্ষায় সম্পৃক্ত করা ও স্বীকৃতি দান, মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, প্রতিটি জেলায় একটি করে সরকারি/বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ, নারীনীতি প্রণয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, ফাইভ-জি মোবাইল প্রযুক্তির ব্যবহার চালুসহ নানা ক্ষেত্রে তার দক্ষ নেতৃত্বের ছাপ রয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও কর্ণফুলী টানেলের মতো বড় বড় প্রকল্পের চ্যালেঞ্জও জয় করেছেন তিনি।

সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সামনে দুর্যোগের সংকটপূর্ণ সময়ে সমাধানের সূত্র তুলে ধরেছেন। যুদ্ধ, অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, ক্ষমতার প্রভাব এবং স্বার্থগত সংঘাতকে বিশ^শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবমুক্তির প্রধান অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তিনি। সেই সঙ্গে জবরদস্তিমূলক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, পাল্টানিষেধাজ্ঞার মতো বৈরীপন্থা পরিহার করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংকট ও বিরোধ নিষ্পত্তির আহ্বান জানিয়েছেন সরকারপ্রধান।

১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণের পর থেকে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে শেখ হাসিনা দলকে সুসংগঠিত করেন। এর ফলে ১৯৯৬ সালে প্রথম, ২০০৮ সালে দ্বিতীয়, ২০১৪ সালে তৃতীয় এবং ২০১৮ সালে চতুর্থবারের মতো নির্বাচনে জয়লাভ করেন তিনি।

দাদা শেখ লুৎফর রহমান ও দাদি সাহেরা খাতুনের অতি আদরের নাতনি শেখ হাসিনার শৈশব-কৈশোর কেটেছে টুঙ্গিপাড়ায়। শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা এবং শেখ রাসেলসহ তারা পাঁচ ভাইবোন। বর্তমানে শেখ হাসিনা ও রেহানা ছাড়া কেউই জীবিত নেই।

শেখ হাসিনার শিক্ষাজীবন শুরু হয় টুঙ্গিপাড়ার এক পাঠশালায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তখন পুরান ঢাকার রজনী বোস লেনে ভাড়া বাসায় ওঠেন তারা।

বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য হলে সপরিবারে ৩ নম্বর মিন্টো রোডের বাসায় বসবাস শুরু করেন। শেখ হাসিনাকে ভর্তি করা হয় টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দিরে। এখন সেটি শেরেবাংলা গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামে পরিচিত।

শেখ হাসিনা ১৯৬৫ সালে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ (বর্তমান বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। ওই বছরেই তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। ১৯৭৩ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

বঙ্গবন্ধুর আগ্রহে ১৯৬৮ সালে পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনার বিয়ে হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানের করাচিতে নিয়ে যাওয়ার পর গোটা পরিবারকে ঢাকায় ভিন্ন এক বাড়িতে গৃহবন্দি করে রাখা হয়।

১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। আর ওই বছরের ১৭ মে ছয় বছরের প্রবাসজীবনের অবসান ঘটিয়ে তিনি মাতৃভূমিতে ফেরেন। তিনি ১৯৯০ সালের ঐতিহাসিক গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর সরকার গঠন করে এবং সে বছরের ২৩ জুন প্রথমবারের মতো তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

শেখ হাসিনা নিজে লেখালেখি করেন, দলের নেতাদেরও লেখালেখিতে উৎসাহ দেন। তার লেখা এবং সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩০টির বেশি। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- শেখ মুজিব আমার পিতা, সাদা কালো, ওরা টোকাই কেন, বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম, দারিদ্র্য দূরীকরণ, আমাদের ছোট রাসেল সোনা, আমার স্বপ্ন আমার সংগ্রাম, সামরিকতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন, বিপন্ন গণতন্ত্র, সহেনা মানবতার অবমাননা, আমরা জনগণের কথা বলতে এসেছি, সবুজ মাঠ পেরিয়ে ইত্যাদি।

সৎ, যোগ্য ও সাহসী নেতার নাম শেখ হাসিনা

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আওয়ামী যুব লীগের আলোচনাসভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ’৭৫-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে সৎ, যোগ্য ও সাহসী নেতার নাম শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা নিজের ভাগ্য ও সুখের জন্য রাজনীতি করেন না, শেখ হাসিনা রাজনীতি করেন মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য, পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য।

শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে ঘর ও সেলাই মেশিন বিতরণআওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ উপকমিটি শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে গতকাল অসহায় গৃহহীন পরিবারের মাঝে ঘর ও দুস্থদের মাঝে সেলাই মেশিন বিতরণ করেছে । দলের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031