বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি রেজিস্ট্রার আমির হোসেন ২০০৯ সালের ২ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের একটি কক্ষের আলমারিতে ব্যক্তিগত কাগজপত্র খোঁজ করছিলেন। এ সময় তিনি ফাইলের স্তূপে কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো একটি মানপত্র দেখতে পান। দুদিন পর ৪ ডিসেম্বর প্রশাসনের কাছে সেটি হস্তান্তর করেন তিনি। এই মানপত্রটিই ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের স্থপতি ও তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে সপরিবারে নিহত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু সেই মানপত্র নিতে পারেননি। বিশ্বিবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও তাকে দিতে পারেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কারও করা হয় তাকে! অপরাধ হলো, চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী ইউনিয়নের কয়েকটি দাবি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। বহিষ্কৃত হলেও তাতে কী? নিজেকে আর থামিয়ে রাখেননি। দেশমাতৃকার জন্য লড়েছেন অবলীলাক্রমে। একসময় তার সাহসী নেতৃত্ব বাঙালিকে এনে দেয় লাল-সবুজের একটি পতাকা। বিশ্ব মানচিত্রে আবির্ভাব ঘটে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ।
advertisement
স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ‘বিশেষ মর্যাদা’ দিয়ে ঋণের বোঝাটা কিছুটা হালকা করবে, এমন প্রত্যাশা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। কিন্তু ঘাতকরা সে ঋণ শোধ করতে দেয়নি। বুলেটের আঘাতে জাতির পিতার সব স্বপ্ন ল-ভ- হয়ে যায়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন হওয়ার কথা ছিল। কলাভবনসহ আরও কয়েকটি ভবন ও হল পরিদর্শন করার কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর। চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সাজিয়েছিলেন পুরো ক্যাম্পাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর জন্য লেখা হয় মানপত্রও। প্রত্যাশা মাখা মানপত্রটির সমাপ্তি টানা হয়েছিল ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ দিয়ে। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসে সেই মানপত্র বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
আটত্রিশ বছর পর ২০১৩ সালে এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাতে ওই মানপত্র, এর কাস্কেট, রুপার তৈরি ক্রেস্ট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামসংবলিত একটি ক্রেস্ট তুলে দেন তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। ক্রেস্ট ও কাস্কেটটি রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে সুরক্ষিত অবস্থায় পাওয়া যায়। সেসব এখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার নয়। তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অন্যায়ভাবে তার ছাত্রত্ব বাতিল করেছিল, যেটি আমরা পরবর্তী সময়ে ফিরিয়ে দিয়েছি। আমরা তার জন্য তৈরি মানপত্র ও উপহারসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় মনে করেছিল, সেই মানপত্র ও উপহারসামগ্রী বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে দিয়ে দেওয়া উচিত। কারণ এসব তার জন্যই। এসব থেকে মানুষ ইতিহাস জানতে পারবে। তিনি চেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দিতে। যদি সে মর্যাদা দিতে পারতেন, তা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বদরবারে বর্তমানে আরও ভালো অবস্থানে চলে যেত।