জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শোকের মাস আগস্টে আমরা হারিয়েছি , বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, দ্বিতীয় পুত্র মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শিশু শেখ রাসেল, সদ্য বিবাহিত পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসেরসহ অনেককেই। ওইদিন হায়েনারা মিন্টো রোডে সরকারি বাসভবনে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও তৎকালীন মন্ত্রী নন্দিত কৃষক নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার একমাত্র মেয়ে বেবি সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত এবং আত্মীয় আবদুল নঈম খান রিন্টুকে। আরেকটি বাসায় হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ও যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মণি এবং তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণিকে। তারা বর্তমান যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস্ পরশ ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপসের মাতা-পিতা। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণ হয়েছে শুনে সেখানে যাওয়ার জন্য রওনা দেন বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ। তাকে ৩২ নম্বরের সামনে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া ওইদিন ৩২ নম্বরের বাড়িতে কর্তব্যরত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকেও হত্যা করা হয়।

ওই নিষ্ঠুর নারকীয় হামলার পর দেখা যায়- ভবনটির প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে রক্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ। তার তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। পাশেই পড়ে ছিল তার ভাঙা চশমা ও অতিপ্রিয় তামাকের পাইপটি। অভ্যর্থনা কক্ষে শেখ কামাল, মূল বেডরুমের সামনে বঙ্গমাতা বেগম মুজিব, বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, নিচতলার সিঁড়ি সংলগ্ন বাথরুমের পাশে শেখ নাসের ও মূল বেডরুমে দুই ভাবির ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল ছোট শিশু শেখ রাসেলের লাশ।
advertisement

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পরই খন্দকার মোশতাক আহমদ- যিনি কিনা বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেন এবং খুনিদের বাঁচানোর জন্য ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন। এর পর ক্ষমতায় আসেন সামরিক শাসক মেজর জিয়া। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনে বৈধতা দেন। এভাবেই এ দেশে খুনের রাজনীতিকে বৈধতা পায়। এর পরবর্তী ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। সব বাধা উপেক্ষা করে এ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ছয় খুনির ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে। এখনো পলাতক রয়েছে কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ, লে. কর্নেল শরীফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল এএম রাশেদ চৌধুরী, রিসালদার (বরখাস্ত) মোসলেম উদ্দিন ও লে. কর্নেল এসএইচ নূর চৌধুরী। আমাদের দাবি হলো, পলাতক সব খুনিকে গ্রেপ্তার করে ফাঁসির রায় কার্যকর করতে হবে। ঘাতকরা কতটা নির্মম হলে এমন হত্যাকা- সংগঠিত করতে পারে- যেখানে অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশু কেউই রেহাই পায়নি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশে না থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। আবার ২০০৪ সালের এ আগস্ট মাসেরই ২১ তারিখে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ওইদিন আওয়ামী লীগ ২৪ নেতাকর্মীকে হারিয়েছে। গ্রেনেড হামলার মধ্যেও মহান আল্লাহতাআলার অশেষ রহমতে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আবারও প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। মহান আল্লাহতাআলা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়ে বাংলাদেশকে রক্ষা করবেন ও দেশের উন্নয়ন এবং জনগণের উন্নতি ও কল্যাণের জন্য কাজ করাবেন বলেই হয়তো তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এর বাস্তব প্রমাণ বর্তমানে আমরা দেখতে পাই সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে চলতি বছরের ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ঐতিহাসিক উদ্বোধনের মাধ্যমে। বাস্তবায়ন হচ্ছে স্বপ্নের মেট্রোরেল, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ মেগাপ্রকল্পগুলো।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বদরবারে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। তিনি আজ যেমন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, তেমনি বিশ্ব নেতা। তাই স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী গাত্রদাহে ভুগছে। আগস্ট মাস এলেই তাদের গাত্রদাহের মাত্রা বেড়ে যায়। শুরু করে নিত্যনতুন ষড়যন্ত্র। তাই আগস্ট মাসে আমাদের বেশি করে সর্তক থাকতে হবে। জাতীয় শোককে শক্তিতে পরিণত করে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্তকারীদের রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। আগামীতে জাতীয় নির্বাচন। এখনই স্বাধীনতাবিরোধীরা ষড়যন্ত্র কূটকৌশল শুরু করে দিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে তারা নির্বাচন কমিশনের সংলাপে পর্যন্ত অংশ নেয়নি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নয়, তারা হত্যা ও ক্যুর মাধ্যমে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়। এটিই তাদের ইতিহাস। স্বাধীনতাবিরোধীদের একটিই লক্ষ্য- যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা আর নিজের আখের গোছানো, সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা। দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণ নিয়ে তাদের কিছু যায় আসে না।

মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধূলিসাৎ করতেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের ঘৃণ্য পরিকল্পনামতো বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। তাকে সপরিবারের হত্যার পরও পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী মৌলবাদী, জঙ্গিগোষ্ঠী তাদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যার জন্য গ্রেনেড হামালা চালায়। এই হামলার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যার মাধ্যমে অসাম্প্রাদায়িক বাংলাদেশে মৌলবাদী পাকিস্তানিধারার রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। দুঃখজনক বিষয় হলো, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সঙ্গে মেজর জিয়া বিভিন্নভাবে জড়িত ছিলেন- যা বর্তমানে নানা বিশ্লেষণ ও বিবেচনার দ্বারা প্রমাণিত। এই হত্যাকা-ে মেজর জিয়া সবচেয়ে লাভবান ও দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ পদে আসীন হন। কিন্তু হত্যা নতুন করে হত্যারই জন্ম দেয়। এ কারণে মেজর জিয়ারও শেষ রক্ষা হয়নি। তাকেও হত্যাকা-ের শিকার হতে হয়েছে। পরে তার সহধর্মিণী খালেদা জিয়া সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেলেও হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি। মেজর জিয়া ও খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানও স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গিগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষক। এ কারণেই খালেদা জিয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ও প্রগতিধারার রাজনীতিকে নেতৃত্বশূন্য করতেই এ হামলা চালানো হয়। এই হামলার পর সঠিক তদন্তের মাধ্যমে দুষ্কৃতকারীদের খুঁজে বের করার পরিবর্তে জজ মিয়া নাটক সাজানো ও হামলার শিকার হওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে বিদ্রƒপ করা হয়। বিএনপি-জামায়াত, স্বাধীনতাবিরোধী ও মৌলবাদী-জঙ্গিগোষ্ঠী যে ওই হামলার সঙ্গে জড়িত, তা আজ আদালতে প্রমাণিত। তাই বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে স্বাধীনতাবিরোধী এই অপশক্তির বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিরন্তর সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। বাংলাদেশকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো মৌলবাদী শক্তির অশুভ ছায়া থেকে মুক্ত রাখতে সর্বদাই সর্তক থাকতে হবে।

আগস্ট হোক স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্তকারীদের রুখে দাঁড়ানোর দৃঢ় প্রত্যয়। একই সঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে- বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশের জন্য রক্ত দিয়ে গেছেন, জীবন দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবাসতেন বলেই ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। আমরা কোনোদিন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের রক্তের ঋণ শোধ করতে পারব না। কিন্তু আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনা, শোষণমুক্ত ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, মানুষকে ভালোবাসা, দেশপ্রেম এবং ত্যাগের নীতিকে অনুসরণ করা তথা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দর্শন বাস্তবায়নের মাধ্যমে কিছুটা হলেও তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারব।

ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ এবং কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031