কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছাতে গিয়ে দুজন অভিবাসন প্রত্যাশীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সীমানা পার হয়ে । অন্যদিকে, মরক্কো থেকে বিশাল এক অভিবাসন প্রত্যাশীর দল গত শুক্রবার উত্তর আফ্রিকায় স্পেনের ছিটমহল মেলিল্লায় ঢোকার চেষ্টা করতে গেলে ২৩ জনের মৃত্যু হয়।

এ ঘটনার তিন দিন পর যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরে টেক্সাসের সান অ্যান্তোনিও শহরের প্রান্তে পরিত্যক্ত একটি ট্রাক থেকে শহরের পুলিশ ৪৬টি মরদেহ উদ্ধার করে। পরে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৩-তে।

যে রুটগুলো ধরে মানুষ ইউরোপ-আমেরিকায় ঢুকতে চেষ্টা করে, তার ওপর কোভিড-১৯ মহামারির কারণে কড়া বিধিনিষেধ আরোপের ফলে বহু দেশে ঢোকা কঠিন হয়ে ওঠে। এখন এসব রুটে আবার মানব পাচার শুরু হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আগামী দিনগুলোতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম তাদের এক হিসাবে বলছে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের গন্তব্যে পৌঁছাতে গিয়ে ২০১৪ সাল থেকে হয় প্রাণ হারিয়েছে, নয়ত নিখোঁজ হয়ে গেছে প্রায় ৫০ হাজার অভিবাসী। সংস্থাটি মনে করে মৃত ও নিখোঁজ মানুষের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে।

আইওএম বলছে, অভিবাসীদের জন্য ভূমধ্যসাগরের মধ্যাঞ্চল বিশ্বের সবচেয়ে বিপদসঙ্কুল পাচার রুটগুলোর অন্যতম। উত্তর আফ্রিকা থেকে ইউরোপে ঢুকতে গিয়ে ২০১৪ সাল থেকে এই পথে প্রাণ হারিয়েছে সাড়ে ১৯ হাজার অভিবাসী।

এসব অভিবাসীদের সীমান্ত পার করার চেষ্টায় প্রায়শই ব্যবহার করা হয় রাবারের ডিঙির মত হাতে তৈরি নৌকা এবং সেগুলোতে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত মানুষ তোলা হয়। ফলে এসব ডিঙি নৌকায় সমুদ্র যাত্রা হয়ে ওঠে বিপজ্জনক এবং মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে খুবই বেশি। এ ধরনের নৌকা সাধারণত চালায় অপরাধী চক্রগুলো এবং মানব পাচারকারীরা।

ভূমধ্যসাগরের মধ্যাঞ্চল দিয়ে ইউরোপে ঢুকতে সমুদ্র যাত্রা শুরু করার মূল পয়েন্ট হল লিবিয়া এবং তিউনিসিয়া। সাগরে ডুবে যাওয়া মানুষকে কবর দেওয়ার জন্য তিউনিসিয়ায় এমনকি আলাদাভাবে সংরক্ষিত কবরস্থানও রয়েছে।

আইওএম’র মুখপাত্র সাফা এমসেহলি বলেন, ‘ভূমধ্যসাগরের এই রুট দিয়ে অভিবাসীদের যাওয়া থেমে নেই। এটা সমুদ্রপথে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক পাচার রুট। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো এই পথে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। রাষ্ট্রগুলো গঠনমূলক কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় মানুষের প্রাণহানি থামছে না।’

ইউরোপিয়ান সীমান্ত ও উপকূলরক্ষীদের সংস্থা ফ্রন্টেক্সের দেওয়া খবর অনুযায়ী ২০১৫ সাল থেকে এই পথে ইউরোপে ঢুকতে গিয়ে বিপদে পড়া তিন লাখ মানুষকে তারা উদ্ধার করেছে।

উত্তর আফ্রিকা পৌঁছানোর জন্য বিপজ্জনক রুট সাহারা মরুভূমি

আফ্রিকান অভিবাসীদের জন্য ইউরোপের পথে পাড়ি জমানোর স্বপ্ন শুরু হয় তাদের নিজেদের মহাদেশের ভেতর দিয়ে যাত্রা শুরুর মধ্য দিয়ে। তাদের গন্তব্য থাকে উত্তর আফ্রিকা আর তার জন্য পার হতে হয় সাহারার দীর্ঘ মরুপথ।

এই পথে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হল প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ। আইওএম’র আনুমানিক হিসাব বলছে, ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সাহারা মরুভূমি পার হতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৪০০ মানুষ।

আইওএম’র সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলা হয়, ‘চোরাকারবারী, মানব পাচারকারী এবং সীমান্ত এলাকার কর্মকর্তাদের হাতে নানাভাবে সহিংসতা ও নিগ্রহের শিকার হয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়। সাহারা মরুভূমির মধ্য দিয়ে পাচারের এই রুটে অভিবাসী মৃত্যুর বড় কারণ হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত

অভিবাসীরা নানা পথে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত পার হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার চেষ্টা করে। আবার কিছু মানুষ হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে অভিবাসীদের যাওয়ার যে রুটগুলো রয়েছে, সেগুলো দিয়ে মানুষ শুধু যে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর চেষ্টাই করছে তা নয়, এসব অভিবাসীদের প্রধান লক্ষ্য থাকে স্বচ্ছল জীবনের আশায় সেখানে নতুন ঘর বাধা। ফলে এসব অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে বেপরোয়া ঝুঁকি নিতেও পিছপা হয় না।

যুক্তরাষ্ট্র আর মেক্সিকোর মধ্যবর্তী সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার মধ্যে বিশাল চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ভৌগলিক কারণে এই এলাকায় চলাচল দুরূহ ও কঠিন। ভৌগলিক প্রতিকূলতার কারণ হিসেবে এলাকায় রয়েছে বিশাল মরু অঞ্চল। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছতে অভিবাসীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো সীমানা বরাবর বয়ে যাওয়া দুর্গম ও বিপজ্জনক নদী রিও গ্র্যান্ডে পার হওয়া।

এই পথে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ নদীতে ডুবে যাওয়া। আইওএম’র আনুমানিক হিসাব বলছে- ২০১৪ সাল থেকে এই নদী পার হতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে তিন হাজারের ওপর অভিবাসী। যারা প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে পথচলা এড়াতে চায়, তারা লরি বা ট্রাকে লুকিয়ে সীমান্ত পার হবার চেষ্টা করে যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করে মৃত্যুর অন্য ধরনের ঝুঁকি, যা দেখা গেছে সম্প্রতি টেক্সাসের সান অ্যান্তনিওতে পরিত্যক্ত ট্রাকে প্রচণ্ড গরমে মৃত্যুমুখে পড়ার ঘটনায।

এ ব্যাপারে সাফা এমসেহলি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী পাচার রুটে সম্প্রতি ব্যাপক সংখ্যায় প্রাণহানির অন্যান্য ঘটনাও ঘটেছে। লাতিন আমেরিকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন প্রত্যাশীরা যে ধরনের বিপদের ঝুঁকি নেয় সে বিষয়ে আইওএম খুবই উদ্বিগ্ন।’

২০২১ সালের ডিসেম্বরে মেক্সিকোর চিয়াপাস থেকে একটি ট্রাক লুকিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে গিয়ে মারা যায় ৫৬ জন অভিবাসী। ট্রাকটি দুর্ঘটনায় পড়ে বিধ্বস্ত হয়।

এশিয়া থেকে বহু মানুষ অভিবাসনের লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন বিপদজ্জনক পথ ধরে পাড়ি জমায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সচ্ছল ও নিরাপদ জীবনের আশায়। পৃথিবীর অন্যান্য পাচার রুট ব্যবহারকারীদের মত এশিয়ান অভিবাসীরাও মানব পাচারকারীদের চক্রগুলোর হাতে নানা ধরনের হয়রানি নির্যাতনের শিকার হয়। এসব পাচারকারীরা তাদের অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাদের নানাভাবে হেনস্তা হয়রানি করে এবং তাদের নানাভাবে আর্থিক বিড়ম্বনা ও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।

ইরান ও তুরস্কের সীমান্ত পারাপার এলাকা

গত বছর আগস্টে আফগানিস্তানের তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এই পথ দিয়ে নজিরবিহীন সংখ্যায় আফগান শরণার্থীরা সেখানে ঢুকেছে। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলছে, ২০ লাখের ওপর আফগান ইরান এবং প্রতিবেশি দেশগুলো শরণার্থী হিসাবে নথিভুক্ত হয়েছে।

আইওএম বলছে, ২০২০ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যত অভিবাসী গেছে তাদের প্রতি দশজনের মধ্যে চারজনেরও বেশির জন্ম এশিয়ায়। এশিয়া মহাদেশে বেশ কিছু প্রধান অভিবাসন রুট রয়েছে।

জাতিসংঘের এই সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী গত আট বছরে এশিয়ায় প্রায় পাঁচ হাজার অভিবাসীর হয় মৃত্যু হয়েছে; নয়ত তারা নিখোঁজ হয়ে গেছে। এই নিহতরা বেশিরভাগই রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশি অভিবাসী।

বাংলাদেশ থেকে অভিবাসীরা সমুদ্রপথে বঙ্গোপসাগর এবং আন্দামান সাগর পার হবার চেষ্টা করে। বিপজ্জনক হলেও এই সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে তারা প্রতিবেশি দেশগুলোতে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছতে চেষ্টা করে। অনেকের প্রধান লক্ষ্য থাকে শেষ পর্যন্ত ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা করা। তাই নানা রুটে তারা ধাপে ধাপে সেই লক্ষ্য অর্জনে এগোয়। বিভিন্ন পর্যায়ে সীমানা পেরতে গিয়ে তাদের যে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় তা খুবই চরম।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031