রবিবার একই সঙ্গে ফরিদপুর, শরীয়তপুর, মুন্সীগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ীতে বয়ে গেছে ঘূর্ণিঝড়। এতে প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত লঘুচাপের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস আগেই দিয়ে রেখেছিল আবহাওয়া অফিস। সেই মতো রবিবার দিনভর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে অনেক শহরের রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। জলাবদ্ধ নগরবাসী পড়েছে দুর্ভোগে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
বরিশালে গত প্রায় ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে জানায় আবহাওয়া অফিস।
রবিবার আবহাওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়, সুস্পষ্ট লঘুচাপের বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় গভীর সঞ্চারণশীল মেঘমালা তৈরি অব্যাহত রয়েছে।
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অফিস।
আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
ভারী বৃষ্টিতে চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা
রবিবার দিনভর ভারী বৃষ্টি হয়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও জেলার অধিকাংশ এলাকায়। নগরীর বড় একটা অংশে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতার। ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
টানা বৃষ্টির কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বিঘ্ন ঘটছে সব ধরনের ব্যবসা ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, রোববার বিকাল ৩টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় এখানে ৯৫.২ মি.মি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
টানা ভারী বৃষ্টির ফলে জলাবদ্ধতার পাশাপাশি যানজট আরও বেড়েছে। নগরীর মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, ষোলশহরসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকার সড়ক এবং নগরীর নিম্নাঞ্চল ও উঁচু এলাকার কিছু সড়কও পানিতে ডুবে গেছে।
নগরীর বাণিজ্য অঞ্চল চাকতাই, আসাদগঞ্জ, বাদুরতলা, বহদ্দারহাট, হালিশহর ও নাসিরাবাদ এলাকায় কাদা পানিতে একাকার।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্নভাবে চললেও জাহাজ থেকে কার্গোতে মালামাল ওঠানামার কাজ বৃষ্টির কারণে ব্যাহত হচ্ছে।
খুলনা নগরীর এক-চতুর্থাংশ প্লাবিত
রবিবার সকাল থেকে শুরু হওয়া ভারী বৃষ্টিপাতে খুলনা নগরীর এক-চতুর্থাংশ প্লাবিত হয়েছে। আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, বিকাল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের আঞ্চলিক পরিচালক আমিরুল জানান, মংলা সমুদ্র বন্দরে ৩ নম্বর সতর্কতা সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
নগরীর কেডিএ এভিনিউ, খানজাহান আলী রোড, লোয়ার যশোর রোড, রূপসা স্ট্যান্ড রোড, শের-ই-বাংলা রোড, ইকবাল নগর, তুতপাড়াসহ বিভিন্ন নিচু এলাকা বৃষ্টির পানিতে ডুবে যায়। এসব এলাকায় যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হয়। আবার সকালে অফিস যাত্রীদের যানবাহনের জন্য বেগ পেতে হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, কাঁচা বাজার, দোকানপাট, বস্তি ও কাঁচাঘর এবং বিভিন্ন ভবনের নিচতলা বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে আছে। বহু হিউম্যান হলার ও ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক জলাবদ্ধ রাস্তায় আটকে যায়।
লণ্ডভণ্ড ফরিদপুর, নিহত ৫
ফরিদপুরের বিভিন্ন এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ে তিন পাটকল শ্রমিকসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক মানুষ। ঝড়ে জেলার শতাধিক বাড়িঘর ও সহস্রাধিক গাছপালা ভেঙে পড়েছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিদ্যুৎব্যবস্থা। গাছপালা উপড়ে পড়ায় মহাসড়কে বন্ধ হয়ে গেছে যান চলাচল। রবিবার বেলা সোয়া একটার দিকে ঘূর্ণিঝড়টি বয়ে যায়।
এর আগে সকাল থেকেই ফরিদপুর ও এর আশপাশের এলাকায় ভারী বৃষ্টি চলছিল। বেলা একটার দিকে শুরু হয় প্রচণ্ড ঝড়। সদর উপজেলার গেরদা ইউনিয়নের বাখুন্ডা এলাকায় দেশের অন্যতম বৃহৎ পাটকল জোবাইদা-করিম জুট মিলের শেডের প্রায় ৫-৬ হাজার বর্গফুট স্টিলের চাল ভেঙে পড়ে। এ সময় চাপা চড়ে এক নারীসহ তিন শ্রমিক নিহত হন।
ঝড়ে গাছচাপা পড়ে সদর উপজেলার কেশবনগর এলাকায় বীরেন বিশ্বাস (৩৫) নামের এক ব্যক্তি মারা যান। এ ছাড়া মানিকগঞ্জ থেকে শ্রমিকের কাজে আসা আবুল হোসেন (৪০) নামের এক শ্রমিক মারা গেছেন কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের দড়ানীপাড়া গ্রামে।
ঝড়ে ফরিদপুর সদর উপজেলার গঙ্গাবর্দী, সাদীপুর ও খুশীরবাজার এলাকায় শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। ঝড়ের তাণ্ডবে বিভিন্ন সড়কে শত শত শতাধিক গাছ ও বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়লে যান চলাচল বিঘ্নিত হয়।
সিরাজগঞ্জে ৪৫ সেকেন্ডে সব তছনছ
রবিবার বিকালে শাহজাদপুরে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড়। মাত্র ৪৫ সেকেন্ডের এই ঝড়ে সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। রবীন্দ্র কাছারি বাড়িসহ সহস্রাধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আহত হয়েছে কমপক্ষে ৩৫ জন। তাদের মধ্যে ১৯ জনকে স্থানীয় হাসপাতাল ও বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে বিদ্যুৎ খঁটি ভেঙে পড়ায় শাহজাদপুরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
এদিকে গাছপালা ভেঙে পড়ায় বগুড়া-নগরবাড়ী মহাসড়কের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় প্রায় দেড় ঘণ্টা পর পুনরায় যানবাহন চলাচল শুরু হয়।
শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম আহমেদ বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে শাহজাদপুর পৌর এলাকা, বেলতলী, খুকনী ও জালালপুর ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম ও মহল্লা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি, আদালত ভবন, উপজেলা ভূমি অফিস, সাব-রেজিস্ট্রার অফিসসহ সহস্রাধিক কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি গাছপালা বিধস্ত হয়েছে। নারী-শিশুসহ আহত হয়েছে কমপক্ষে ৩৫ জন।
মুন্সীগঞ্জে ঝড়ে আহত অর্ধশতাধিক
ঘূর্ণিঝড়ে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক মানুষ। তাদের স্থানীয় হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
লৌহজং উপজেলার ইউনো মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান জানান, রবিবার সকাল ১০টার দিকে হঠাৎ এই ঝড়ের কবলে পড়েন এলাকাবাসী।
ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১০-১২টি পরিবারের ঘরবাড়ি, ১৫টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। একটি মাছের বাজার সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিনি জানান, এ ঘটনায় নারী-পুরুষসহ ৫০ জনের বেশি নারী-পুরুষ আহত হয়েছেন। মো. সোহেল সরর্দার (৫২) ও মো. শেরু ফকির (৫০) নামে দুজন গুরুতর আহত হওয়ায় তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। অন্যদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
শরীয়তপুরে শতাধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত
জাজিরা উপজেলার পূর্ব নাওডোবায় ঘূর্ণিঝড়ে শতাধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখানে আহত হয়েছে ১০ জন। রবিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হাজী অসিম উদ্দিন মাদবর কান্দি, মঙল মাঝির কান্দি, মঙল মাঝির ঘাট ও পানিপাড়া গ্রামে হঠাৎ করে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এসব এলাকায় সোবাহান বেপারী, হাকিম বেপারী, হাসনা বেগমসহ প্রায় ২০ জন আহত হন।
টানা বর্ষণে বিপর্যস্ত ভোলা
রবিবার দিনভর বৃষ্টি ও ঝড় বইয়ে গেছে ভোলায়। টানা বর্ষণে শহরের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। শহরের ওয়াস্টেন পাড়া, পৌর চরনোয়াবাদ, বিএভিএস সড়ক এলাকায় দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা।
ঝড়ো বাতাসের কারণে শহরের আলিয়া মাদ্রাসা এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গাছ উপড়ে পড়ায় ভোলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ সকাল থেকে বন্ধ রয়েছে।
আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ জামিল হোসেন জানিয়েছেন, লঘুচাপের কারণে সকাল থেকে ভোলায় ২৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
বরিশালে ৪৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত
বরিশাল আবহাওয়া অফিস জানায়, রবিবার বরিশালে রেকর্ড বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত ৪৯ বছরে এমন বৃষ্টিপাত আর কখনো হয়নি।
বরিশাল আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র অবজারভার আনিসুর রহমান ঢাকাটাইমসকে জানান, রবিবার রাত ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশালে ২৭৪ দশমিক ১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, বরিশাল আবহাওয়া অফিসের হিসাব মতে বরিশালে গত ৪৯ বছরে এ রকম বৃষ্টিপাত আর হয়নি।
এ বৃষ্টিপাতের ফলে বরিশাল নগরীসহ বিভিন্ন উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া নগরীর সদর রোডসহ বিভিন্ন সড়কে ছিল হাঁটু সমান পানি।
তলিয়ে গেছে মাদারীপুর শহর
রবিবার ভোর থেকে টানা বর্ষণে মাদারীপুর পৌর শহর হাঁটুপানিতে তলিয়ে গেছে। এতে চরম বিপাকে পড়েছে মানুষ।
শহরের প্রধান প্রধান সড়ক পানিতে ডুবে যায়ওয়ায় যান চলাচলে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ রয়েছে।
রাজবাড়ীতে ঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি
রবিবার দুপুরে রাজবাড়ী জেলার উপর দিয়ে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড়। জেলা সদরের রামকান্তপুর, মিজানপুর ও বালিয়াকান্দি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের কয়েক শত ঘর ও সহস্রাধিক গাছপালা ভেঙে গেছে।
পাবনায় পাঁচ মিনিটের তাণ্ডব
পাবনার আটঘরিয়ার তিনটি গ্রামের উপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে। এতে দুটি গ্রামের অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি ও গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
রবিবার দুপুরে বৃষ্টির সাথে এ ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়।
দেবোত্তর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহায়মীন হোসেন চঞ্চল জানান, উপজেলার দেবোত্তর ইউনিয়নের রায়পুর, চাঁদপুর ও গোরুরি গ্রামের উপর দিয়ে দুপুরে ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। এতে গোরুরি এতিমখানাসহ তিনটি গ্রামের অর্ধশতাধিক ঘর-বাড়ি, প্রায় চার শতাধিক গাছপালা দুমড়েমুচড়ে যায়।