সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ কর দিয়ে বৈধ করার যে সুযোগ নতুন অর্থবছরের বাজেটে দেওয়া হচ্ছে, তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না বলে মনে করছে । ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে গতকাল সিপিডির পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বেসরকারি এ গবেষণা সংস্থার সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজেটে মূল্যস্ফীতির চাপ সহনীয় রাখার জন্য যে উদ্যোগ ও উদ্যম আছে, তার চেয়ে বেশি আগ্রহ বিশেষ কিছু মানুষকে, যারা দেশের প্রচলিত আইন কানুন ভঙ্গ করে টাকা নিয়ে গেছেন বাইরে, তাদের নিয়ে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন। তার ভাষায় এটি ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তনের’ বাজেট। এ বাজেটের বিশাল ব্যয় মেটানোর জন্য অর্থ সংগ্রহে অর্থমন্ত্রী নতুন একটি পথ খুঁজে বের করেছেন। বিদেশ থাকা সম্পদের ‘দায় মুক্তির’ দিয়ে তিনি তা দেশে আনার ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে ১৫ থেকে ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিদেশে থাকা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি দেশে সরকারের খাতায় বৈধ আয়ের তালিকায় যুক্ত করা যাবে, সেই অর্থ দেশেও আনা যাবে। ওই আয়ের উৎস জানতে চাওয়া হবে না। এ সুযোগের সমালোচনা করে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ প্রস্তাব নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য না, অর্থনৈতিকভাবে যৌক্তিক না এবং রাজনৈতিকভাবেও এটা জনগণের কাছে উপস্থাপন করা যাবে না। সিপিডি সবসময় এই ধরনের পদক্ষেপের বিরোধিতা করে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখন আরও জোরালোভাবে বিরোধিতা করার সময় এসেছে। খবর বিডিনিউজের।
গুলশানের লেকশোর হোটেলে এই বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, জেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খানসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন সেখানে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অনেকে দেশে অবৈধ উপায়ে টাকা আয় করে সেটা বিদেশে নিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে টাকা বাইরে নিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পিকে হালদারের বিপুল অর্থ পাচারের প্রসঙ্গ ধরে তিনি বলেন, কিছুদিন আগেও বহুল আলোচিত একটি কেইস সম্পর্কে আপনারা ভালো জানেন। সেই ঘটনা নিয়ে যদি তখন আলোচনা না হয়ে এখন আলোচনা হতো, তাহলে দেখা যেত যে তার কোনো অপরাধই হয়নি। তিনি বাইরে যে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার মতো নিয়ে গেছেন, সেটা তিনি ডিক্লেয়ার করে ৭, ১০ বা ১৫ শতাংশ দিয়ে এটাকে বৈধ করে দেশে আসতে পারতেন। এই ধরনের সুযোগ আমাদের নীতি এবং নৈতিকতার সঙ্গে খাপ খায় না। এর আগেও আমরা দেখেছি বিভিন্ন ধরনের সুযোগ দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে ওই প্রক্রিয়াও আমাদেরকে তেমন রাজস্ব দেয়নি।
তিনি বলেন, এ ধরনের সুযোগ দিলে ভবিষ্যতে যারা বাইরে টাকা পাচার করার চিন্তা করতেন না, তারাও কিন্তু মনে করবেন যে আমি এখানে ২৫ শতাংশ আয়কর বা ৪২ শতাংশ কর্পোরেট ট্যাক্স দিয়ে লাভ কী? আমি তো এটাকে বাইরে নিয়ে গেলে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ কর দিয়ে এটাকে বৈধ করে নিয়ে আসতে পারব। সরকারের এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে ‘দেশের টাকা উল্টো বাইরে নিয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা’ সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সরকারি পেনশন এবং সরকারি বিভিন্ন ইনস্ট্রুমেন্ট যে ভর্তুকি দেওয়া হয়, এই দুটি বাদ দিলে নতুন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের প্রকৃত বরাদ্দ আসলে তিন হাজার কোটি টাকা কমে গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে ছয়টি চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী, কিন্তু সেসব মোকাবিলার কৌশল বাজেটে স্পষ্ট হয়নি। প্রস্তাবিত বাজেট আরও সৃজনশীলতার দরকার ছিল, প্রাধিকারের খাতগুলোতে বরাদ্দ দেওয়ায় আরও নমনীয় হওয়া দরকার ছিল। বাজেট বিষয়ক পদক্ষেপগুলোর ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ দেওয়ার দরকার ছিল, যা দিয়ে বর্তমানে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা যায়। সিপিডি মনে করে, আমরা যে ছয়টি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছি, সেগুলো সরকারও করেছে। কিন্তু সেগুলো কীভাবে মোকাবিলা করা হবে তার স্পষ্ট পদক্ষেপ নাই।
তিনি বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা কিসের ভিত্তিতে করা হয়েছে তা তাদের কাছে বোধগম্য নয়। বাস্তবতার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের যে দাম, তার সঙ্গে সরকারের তথ্যের কোনো মিল নেই।
সারা বিশ্ব যখন অর্থনৈতিক মন্দায় পড়তে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেখানে বাজেটে এত কম মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য কীভাবে অর্থমন্ত্রী পূরণ করবেন, সেই প্রশ্ন রাখেন ফাহমিদা। তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রী হয়ত ভাবছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, করোনা মহামারীসহ বর্তমান সংকট দ্রুত কেটে যাবে। কিন্তু কোন জাদুর কাঠি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো হবে, সে পথ দেখাননি তিনি।
সামগ্রিক বাস্তবতায় আগামী অর্থবছরে প্রান্তিক মানুষের জন্য অতিরিক্ত বরাদ্দের দাবি থাকলেও বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রকৃত বরাদ্দ উল্টো কমে গেছে বলে মনে করছে সিপিডি। ফাহমিদা বলেন, প্রস্তাবিত বরাদ্দ থেকে সরকারি পেনশন, ভাতা এবং সরকারি বিভিন্ন ভর্তুকি দিলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ তিন হাজার কোটি টাকা কমে গেছে।
সঞ্চয়ের ওপর কর রেয়াতের প্রস্তাবকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে দেখছে সিপিডি। তাদের বিচারে সকল রপ্তানি শিল্পের কর্পোরেট কর হার ১২ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্তও ইতিবাচক। কিন্তু তা প্রান্তিক মানুষের কোনো কাজে আসবে না।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, আগামী অর্থবছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান বেড়ে ৮৬ দশমিক ২ শতাংশ হবে বলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এটা কীভাবে হবে সেটা অর্থমন্ত্রী বলেননি। সরকারের দেশি ও বিদেশি ঋণের পরিমাণ এখন সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও তা ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখনো আমাদের বিদেশি ঋণের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে। কারণ আমরা যখন স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় উন্নীত হব, তখন আমরা আর কম সুদের ঋণ পাব না।
বাজেটে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের যে টার্গেট দেওয়া হয়েছে, তা অর্জন প্রায় অসম্ভব মনে করেন ফাহমিদা। তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরেই প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি হতে পারে। সেখানে আগামী অর্থবছরের জন্য অতিরিক্ত আরও ৪০ হাজার কোটি টাকা টার্গেট পূরণ প্রায় অসম্ভব। তবে চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ে যে প্রবৃদ্ধি, সেটা ইতিবাচক মন্তব্য করে তিনি আগামী অর্থবছরের রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন। পরোক্ষ কর বাড়ানোর যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা হলে রাজস্ব আদায় বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক। সরকারি অর্থ সঞ্চালনা বাড়ানোর পাশাপাশি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে জোর দেওয়ার তাগিদ দেন তিনি আগামী বছর দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির গতি প্রবাহ আরও বাড়িয়ে নিতে ।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031