সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ শুরু থেকেই পলাতক ঘোষণা করেছেন জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানকে । আপিল বিভাগ বলেছেন, একজন পলাতক আসামির মামলা শুনে হাইকোর্ট আইনানুযায়ী ভুল করেছে। একই সঙ্গে সংবিধান বহির্ভূতভাবে জোবায়দাকে দেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত সুবিধা। মামলাটি বাতিল চেয়ে জোবায়দা রহমানের করা লিভ টু আপিল খারিজ করে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এমন অভিমত এসেছে।
এর আগে গত ১৩ এপ্রিল প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ জোবায়দা রহমানের লিভ টু আপিল খারিজ করে সংক্ষিপ্ত রায় দেন। গতকাল বুধবার আপিল বিভাগ ওই রায়ের ১৬ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুুলিপি প্রকাশ করেন। রায়টি লিখেছেন বিচারপতি বোরহানউদ্দিন। রায়ে একমত পোষণ করেছেন প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান ও বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম।
রায়ে বলা হয়েছে, দুর্নীতির মামলায় জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয়নি বিচারিক আদালত। যেখানে অভিযোগ আমলে নেয়নি সেখানে কী করে উনি মামলা বাতিল চেয়ে ৫৬১ক ধারায় আবেদন করেছেন। আর যখন আবেদনটি করেছেন তখন উনি আইনের দৃষ্টিতে পলাতক। আইনের দৃষ্টিতে একজন পলাতক ব্যক্তির করা ওই আবেদন শুনে মামলার বিচার কাজ স্থগিতের পাশাপাশি রুল জারি করেছে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ। আমরা মনে করি হাইকোর্টের এ ধরনের আদেশ প্রদান আইনানুযায়ী সঠিক ছিল না। কারণ আইনের দৃষ্টিতে পলাতক ব্যক্তির আইনি প্রতিকার চাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দুর্নীতির মামলা বাতিলে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১ক ধারায় করা তার আবেদন শুনে ও আদেশ দিয়ে হাইকোর্ট আইনানুযায়ী ভুল করেছে।
আপিল বিভাগ রায়ে আরও বলেছে, সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকরা ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে ও পক্ষপাতিত্বের আশ্রয় না নিয়ে বিচার কাজ পরিচালনার শপথ নিয়েছেন। যে কোন পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগ এই নীতিতে অবশ্যই অটল থাকবে। বিচার বিভাগ এমন কোন নজির সৃষ্টি করবে না যা সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। রায়ে আপিল বিভাগ বলেছে, প্রত্যেক নাগরিকের আদালত থেকে সমান বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছেন। কারণ আইনের দৃষ্টিতে কেউ বড় বা ছোট নয়, সকলেই সমান।
এ রায়ের ব্যাপারে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, আত্মসমর্পণ না করেই মামলা বাতিল চেয়ে সরাসরি এ ধরনের একটি আবেদন হাইকোর্টে করা নজিরবিহীন। আপিল বিভাগ একটি কথা বারবার বলেছেন, ফিউজিটিভ ফোরাম জাস্টিস। আইনের দৃষ্টিতে তিনি প্রথম থেকেই পলাতক। যেদিন মামলা বাতিল আবেদনের এফিডেভিট দাখিল করেছেন, সেদিনও উনি পলাতক ছিল। একজন পলাতক আসামি কিভাবে এই মামলা দায়ের করলেন, এরপর হাইকোর্ট কিভাবে এই মামলাটি গ্রহণ করল এবং শুনল তা নিয়ে আপিল বিভাগ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। আপিল বিভাগ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা করে বলেছেন, আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। সবাই সমান অধিকার লাভের অধিকারী হলেও জোবায়দা রহমানকে অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে। যে কারণে সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন হয়েছে এবং হাইকোর্টের একটি খারাপ নজির সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ আরও বলেছেন হাইকোর্ট বিভাগ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করেছে। কোনো ব্যক্তি/আসামি পলাতক হলে কোনো রিট, ফৌজদারি মামলা বা কোনো আইনগত পদক্ষেপই নিতে পারেন না আত্মসমর্পণ করা ছাড়া। কিন্তু হাইকোর্ট আইন বহির্ভূতভাবে জোবায়দা রহমানকে বেশি সুবিধা দিয়ে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন। এখন জোবায়দা রহমানকে আগে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যেতে হবে, তারপর আইনগত পদক্ষেপ নিতে হবে বলেও জানান দুদকের এই আইনজীবী।
২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ঘোষিত আয়ের বাইরে ৪ কোটি ৮১ লাখ ৫৩ হাজার ৫৬১ টাকার মালিক হওয়া ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে রাজধানীর কাফরুল থানায় এ মামলা দায়ের করে দুদক। মামলায় তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমান ও শাশুড়ি ইকবাল মান্দ বানুকে আসামি করা হয়। পরে একই বছরে জোবায়দা রহমানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
ওই রুলের শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে মামলা বাতিলে জারি করা রুল খারিজ করে দেন। একইসঙ্গে জোবায়দা রহমানকে আট সপ্তাহের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওই বছর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল আবেদন করেন জোবায়দা রহমান। ওই আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গত ১৩ এপ্রিল আপিল বিভাগ জোবায়দা রহমানের আবেদন খারিজ করে রায় দেন। জোবায়দা রহমান পলাতক ঘোষণা করার পাশাপাশি তাকে ৮ সপ্তাহের মধ্যে আত্মসমর্পণের যে আদেশ হাইকোর্ট দিয়েছিলেন, সেটাও বাতিল করেছেন গতকাল প্রকাশিত রায়ে ।