এক নারী প্রসববেদনায় ছটফট করছিলেন । একপর্যায়ে তাকে নেওয়া হয় ক্লিনিকের অপারেশন থিয়েটারে (ওটি)। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযান পরিচালনাকারী দল আসার কথা শুনেই হাসপাতালে তালা লাগিয়ে পালিয়ে যান মালিকসহ সব স্বাস্থ্যকর্মী। গতকাল রবিবার এই ঘটনা ঘটেছে নারায়ণগঞ্জের শিমরাইলের পদ্মা জেনারেল হাসপাতালে। ঘটনার আকস্মিকতায় অধিদপ্তরের অভিযান পরিচালনাকারী কর্মকর্তারা অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। প্রসূতিকে বাঁচাতে তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিদের্শনায় ভেঙে ফেলেন হাসপাতালের ফটক। রোগীকে দ্রুত নিয়ে যান মাতুয়াইল শিশু মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে। এ ছাড়া ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও ৩ রোগীকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. বেলাল হোসেন জানিয়েছেন, ঘোষিত ৭২ ঘণ্টার অভিযানে দেশের ৮ বিভাগের ৮৮২ অনিবন্ধিত হাসপাতাল-ক্লিনিকের অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলায় ১৬৭টি (সিটি করপোরেশনসহ), চট্টগ্রামে ২২৯টি, রাজশাহীতে ৭৮টি, রংপুরে ১৪টি, ময়মনসিংহে ৯৬টি, বরিশালে ৫৯টি, সিলেটে ৩৫টি এবং খুলনায় ২০৪টি। অভিযানে ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় ১২টি ক্লিনিক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত শনিবার ৭টি এবং গতকাল ৫ ক্লিনিক বন্ধ করা হয়। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ীর ৩টি, ধানমন্ডিতে ৪টি, নাজিমউদ্দিন রোড এলাকার দুটি এবং মোহাম্মদপুর, বনানী ও বারিধারার তিনটি ক্লিনিক রয়েছে। অভিযানের বিষয়ে গতকাল বিকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সভাকক্ষে অতিরিক্ত মহাপরিচালকের (প্রশাসন) সভাপতিত্বে জরুরি সভা হয়। সভায় পরিচালক (প্রশাসন) ও পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া দেশের বিভাগীয় আট পরিচালক এবং অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত রাখতে দেশের সব বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ ছাড়া অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাহিনীর সহযোগিতা অব্যহত রাখার কথা বলা হয়। এ সময় অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অনিবন্ধিত এসব হাসপাতালের কার্যক্রম একেবারে বন্ধ না করে ধীরে ধীরে নিবন্ধনের আওতায় আনার বিষয়ে মত দেন।

সভায় উপস্থিত কর্মকর্তারা জানান, অভিযানের সামগ্রিক বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক সংবাদ সম্মেলন করে জানাবেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখা জানিয়েছে, গতকাল মোট তিনটি দল অভিযানে বের হয়। তারা রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৫টি হাসপাতাল সিলগালা করে দেয়। এ সময় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দুটি টিম অভিযান চালায়।

এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ বলেন, দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে শৃঙ্খলায় ফেরাতে এ ধরনের অভিযান চালানো দরকার। এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকলে যেমন খুশি তেমনভাবে হাসপাতাল চালানো বন্ধ হয়ে যাবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখা জানায়, দেশে নিবন্ধিত স্বাস্থ্যসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১০ হাজার ৮৯৩টি। এর মধ্যে সাত হাজার ২৬টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, তিন হাজার ৭০৫টি হাসপাতাল এবং ১৬২টি ব্লাডব্যাংক। তবে নিবন্ধনের বাইরে কী পরিমাণ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। এবারের তিন দিনের অভিযানে এ ধরনের ৫৩৮টি হাসপাতাল চিহ্নিত হয়েছে। অভিযান চলতে থাকলে এই সংখ্যা কয়েক হাজারে ঠেকতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর হাসপাতাল-ক্লিনিকে অভিযান চালানোর আগ্রহ প্রকাশ করে। আবার জাতীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানও এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অনেকটা হঠাৎ করেই অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়।

এদিকে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা আক্কাস আলী শেখ গণমাধ্যমে জানান, অভিযানের বিষয়ে বিকাল ৪টায় সংবাদ সম্মেলন হবে। কিন্তু বিকাল পোনে ৩টার দিকে অনিবার্য কারণে সংবাদ সম্মেলন বাতিল করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জেনেভায় আছেন। তারা সোমবার (আজ) দেশে ফিরবেন বলে জানা গেছে। তাই তাদের উপস্থিতিতেই সংবাদ সম্মেলন হবে।

গত ২৫ মে সিদ্ধান্ত হয়, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দেশের অনিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করতে হবে।

খুলনা : গতকাল খুলনা মহানগর এলাকায় ১২টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালায় স্বাস্থ্য বিভাগ। এর মধ্যে লাইসেন্স না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে ৮ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। এগুলো হলো- সাউথ সিটি ডায়াগনস্টিক, ডেল ইউ ক্লিনিক, পপুলার ডায়াগনস্টিক, সিটি ম্যাক ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ম্যাক হেলথকেয়ার সেন্টার, বয়রা সেন্ট্রাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রেডিয়েন্স ক্লিনিক্যাল আল্ট্রা সাউন্ড এবং এডি হাসপাতাল।

রাজবাড়ী : জেলা শহরের ৪টি, পাংশা উপজেলায় ২টি ও বালিয়াকান্দি উপজেলায় ৪টি বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ছাড়া অন্য একটি ক্লিনিককে ১০ হাজার টাকা, একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা ও মালিককে ১৫ দিনের কারাদ- দেওয়া হয়। সিলগালা হওয়া ক্লিনিকগুলো হলো- রাজবাড়ী জেলা শহরের আল রাজি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ডিজিটাল ক্লিনিক রাজবাড়ী, মেরি ক্লিনিক, শেফা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, পাংশা উপজেলার মা ও শিশু ডায়াবেটিক সেন্টার, এনআর ক্লিনিক, বালিয়াকান্দি উপজেলার আরোগ্য ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, জামালপুর প্যাথলজি সেন্টার, দ্য অ্যাপালো ও জননী ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

বাগেরহাট : মোংলায় অবৈধ ৯টি ক্লিনিক ও প্যাথলজি সিলগালা করে উপজেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ। সিলগালা করা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- মোংলা হাসপাতাল সড়কের রাতুল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সেবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, লিয়ান ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রাজিয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং মাদ্রাসা রোডের রাব্বি ডায়াগনস্টিক ও ক্লিনিক, মুনতাহা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, তালুকদার আব্দুল খালেক সড়কের খাঁন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও দিগরাজ এলাকার খাঁন জাহান ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

সাভার : ঢাকার সাভার উপজেলায় গতকাল অনিবন্ধিত ৩টি ক্লিনিক সিলগালা করে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। এ ছাড়া দুটি ক্লিনিকের কাগজপত্রের ত্রুটি ঠিক করতে সাত দিনের সময় দেওয়া হয়। সিলগালা করা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- সাভার যমুনা ডিজিটাল ল্যাব অ্যান্ড হাসপাতাল, কেয়ার ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টার এবং দেশ ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

ধর্মপাশা (সুনামগঞ্জ) : ধর্মপাশায় জননী এক্সরে ক্লিনিকের লাইসেন্সের মেয়াদ না থাকায় সিলগালা করেন ভ্রাম্যামাণ আদালত। আদালত পরিচালনা করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুনতাসির হাসান।

নাঙ্গলকোট (কুমিল্লা) : উপজেলায় ৫টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা ও তিনটিকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সিলগালা করা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- নাঙ্গলকোট বাজারের পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ল্যাব ওয়ান ডায়াগনস্টিক, নাঙ্গলকোট ডক্টরস ল্যাব, বাহুড়া বাজারের শাহজাহান মেডিক্যাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসানপুর আল নূর ডায়াগনস্টিক।

শ্রীপুর (মাগুরা) : প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় একটি হাসপাতাল এবং দুটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা করা হয়। প্রতিষ্ঠান দুটি হলো- খামারপাড়া সততা (প্রাঃ) হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শ্রীপুরের দ্য এ্যাপোলো সেন্টার অ্যান্ড প্যাথলজি ও দারিয়াপুরের গুডলিংক এক্সরে অ্যান্ড প্যাথলজি সেন্টার।

বিশ্বনাথ (সিলেট) : বিশ্বনাথে গতকাল দুই ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এর মধ্যে উপজেলা সদরের নতুন বাজারের সন্ধানী ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ২০ হাজার ও মা-মণি ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

বেনাপোল (যশোর) : বেনাপোলে গতকাল স্টার ডায়াগনস্টিক ও বেনাপোল ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামে দুটি প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ।

পীরগঞ্জ (ঠাকুরগাঁও) : পীরগঞ্জে একটি ক্লিনিক ও একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এর মধ্যে অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ৫ হাজার টাকা এবং অব্যবস্থাপনা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে না পারায় রঘুনাথপুরের আধুনিক ক্লিনিক অ্যান্ড নাসিং হোমকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

মৌলভীবাজার : শ্রীমঙ্গল উপজেলার ইনোভা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও রেটিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, জুড়ী উপজেলার ফুলতলায় হেলথ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুরের মৃত্তিকা ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা করে দেওয়া হয়।

দেবিদ্বার (কুমিল্লা) : চান্দিনা রোডের আল মদিনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ট্রমা সেন্টার বন্ধ করে দেয় উপজেলা প্রশাসন। পাঁচ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়।

চকরিয়া (কক্সবাজার) : ৫টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা করে উপজেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালত। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- চকরিয়া পৌরশহরের একুশে ডায়াগনস্টিক, সেন্ট্রাল হাসপাতালের প্যাথলজি ডিপার্টমেন্ট, বদরখালী জেনারেল হাসপাতালের প্যাথলজি ডিপার্টমেন্ট, বদরখালী ল্যাব ও হাউবদরখালী মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারস।

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031