‘বায়রা সিন্ডিকেটবিরোধী মহাজোট’ মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার বন্ধের মূল অন্তরায় হিসেবে ২৫ প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছে। তারা বলছে, দ্রুত এ সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। নইলে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে এবং শ্রমবাজার খুলতে অনেক সময় লেগে যাবে। আর দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ থাকায় বাংলাদেশে ডলারের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে।
গতকাল শনিবার রাজধানীর বনানীতে হোটেল শেরাটনে এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ অভিমত তুলে ধরেন। ‘মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে কোনো প্রকার সিন্ডিকেটকে অনুমোদন না দিয়ে বাংলাদেশের কম্পিটিশন আইন অনুযায়ী এবং মালয়েশিয়ায় অন্যান্য শ্রমিক প্রেরণকারী ১৩টি সোর্স কান্ট্রির ন্যায় বাংলাদেশের সকল বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য শ্রমবাজার উন্মুক্তকরণ’ শীর্ষক এ গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করে ‘বায়রা সিন্ডিকেটবিরোধী মহাজোট’।
বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে মালয়েশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই (এমওইউ) হয়েছে প্রায় পাঁচ মাস আগে। এত দিনেও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। থমকে আছে পুরো প্রক্রিয়াই।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের দেশের প্রধান চালিকাশক্তি হলো জনগণ। এ শক্তি কাজে লাগাতে হবে। বিশ^-অর্থনীতির এই মন্দার সময় বিদেশের শ্রমবাজার আমাদের অন্যতম শক্তির জায়গা।’ স্বল্প ব্যয়, ন্যায্য মজুরি ও নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে ‘সিস্টেম’ পরিবর্তনের কথাও বলেন তিনি।
ইউনিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও বায়রার সাবেক সভাপতি মোহা. নূর আলী বলেন, ‘সিন্ডিকেট যদি ভালো মাধ্যম হয়, তাহলে সিন্ডিকেট হোক। কিন্তু আমাদের সরকারকে হিসাব করতে হবে, দেশের জন্য সিন্ডিকেট লাভ না লোকসানের। আমি প্রথমেই বলব, আবার চিন্তা করুন, এই সিন্ডিকেট দেশের কোনো স্বার্থ বয়ে আনবে কিনা। এই সিন্ডিকেটে দেশের কোনো লাভ নেই; এই সিন্ডিকেট দিয়ে এ খাতের কোনো লাভ নেই। কেন লাভ নেই? এখানে প্রথমেই বলব, সিন্ডিকেট যদি হয়, তাহলে খরচ বেড়ে যাবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কাউকে যেন বিদেশ যেতে বাড়িঘর বিক্রি করতে না নয়, ব্যাংক থেকে যেন ঋণ নিতে না হয়। একজন শ্রমিক যখন মালয়েশিয়া যাবেন, সিন্ডিকেটকে যে টাকা দেবেন, সেই টাকা তুলতে তার দুই বছর সময় লেগে যাবে। আর তাই যদি হয়, তাহলে আমরা যদি দুই বছর লোক নাও পাঠাই, তাও কিন্তু আমরা ভালো থাকব। সুতরাং আমি মনে করি, শ্রমিক পাঠাতে আমাদের যে খরচ, সেটা আরও বেড়ে যাবে। যেহেতু বেড়ে যাবে, সেহেতু এই সিন্ডিকেট দরকার নেই। এখানে আরেকটি কথা আমি বলব, সিন্ডিকেট যদি হয় ২৫ জনের, তো ২৫ জনের এমপ্লয়ি হবে। যেখানে ১৫ থেকে ২০ লাখ লোক নেওয়া হবে, সেখানে ২৫ জনের পক্ষে কি সম্ভব? কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমি আরেকটা কথা বলব, এই ২৫ জন কারা? এই ২৫ জনের যোগ্যতা কতটুকু? এখানে যদি দুই-চার-পাঁচজন হতো, তাহলেও চলত; কিন্তু কমপক্ষে ২০ জন আছে, যাদের এই খাতে লোক পাঠানোর কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। তাহলে এরা কীভাবে লোক পাঠাবে? এই সিন্ডিকেট কার স্বার্থে? দেশের স্বার্থে? নাকি একজন ব্যক্তি স্বার্থে, যার অডিও রেকর্ড সামনে আসছে। এই লোকের স্বার্থে আমরা কি কাজ করব, নাকি দেশের স্বার্থে কাজ করব? সুতরাং এখানে ১৫ থেকে ২০ লাখ লোক পাঠাতে হলে কোনোভাবে এদের দ্বারা পাঠানো সম্ভব নয়।’ তিনি বলেন, ‘এই যে স্ববিরোধী বক্তব্য মালয়েশিয়ার হিউম্যান রিসোর্স মিনিস্টার দিয়েছেন, তার দেশে ৫১৩ রিক্রুটিং এজেন্সি আছে; তারা ভ্যালিড, তারা সবাই বিজনেস করতে পারবে। আর আমার দেশের ১ হাজার ৫০০ রিক্রুটিং এজেন্সি আছে, তারা বিজনেস করতে পারবে না। তাদের মধ্য থেকে ২৫ জন করবে। এই অথরিটি কে দিয়েছে তাদের? কে তাকে অথরিটি দিয়েছে? কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সিকে বাছাই করা হয়েছে। এই ২৫ জনের যোগ্যতাটা কী?’
মোহা. নূর আলী বলেন, ‘এখানে আমার আরেকটা প্রশ্ন হলো, লাইসেন্স দিয়েছে আমাদের সরকার, সিকিউরিটিও আমাদের সরকারের কাছে আছে; কমিটমেন্টও আছে। আমি কমিটমেন্ট রাখব কী রাখব না, সেটা জানে আমার সরকার। সেখানে মালয়েশিয়ার হিউম্যান রিসোর্স মিনিস্টার কীভাবে জানেন, কে ভালো আর কে মন্দ! এই ২৫ জনের যোগ্যতা কীভাবে তিনি নির্ধারণ করলেন? এগুলো হাস্যকর। একটু চিন্তা করলে পরিষ্কার বোঝা যায়, এখানে দুর্নীতি জড়িত। বোঝা যায়, এখানে যারা ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে আছেন, কেউ বাদ যাচ্ছেন না; বড় ধরনের লোভ দেখাচ্ছে। কথায় আছে, পৃথিবীর মধ্যে শ্রমিক পাঠানোর খরচ বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। এটার কারণ হচ্ছে সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের কারণেই শ্রমিক পাঠানোর খরচ বেড়ে যায়।’
মোহা. নূর আলী আরও বলেন, ‘আমাদের সরকার কি মালয়েশিয়া সরকারকে বলতে পারে না যে, তোমার দেশ তো অনেক অ্যাডভান্স; তোমার দেশে অনেক আইনি ব্যবস্থা আছে। তোমরা আরও একটা বা দুইটা ব্যবস্থা দাও। একাধিক ব্যবস্থা থাকলে অসুবিধা কী? যদি আমার দেশের জনগণের জন্য, আমার রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য একাধিক সিস্টেম থাকে, তাহলে সেই প্রস্তাব আমরা কেন দিচ্ছি না?’
মোহা. নূর আলী বলেন, ‘আমরা তিন-চার বছর আগে ঘোষণা দিয়েছি, কম খরচে শ্রমিক পাঠাব। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারণে এখন খরচ বেড়ে যাবে। ট্রাফিক সিস্টেমে আমরা জানি, যখন লালবাতি জ্বলে, তখন আমরা থেমে যাই। আর সবুজ বাতি যখন জ্বলে, তখন আমরা সবাই চলি। কিন্তু সেই ধরনের লালবাতি, নীলবাতি তো আমাদের ম্যানপাওয়ার মিনিস্ট্রিতে নেই। তাহলে মাইগ্রেশন খরচ কীভাবে কমবে? যে যা নিতে পারে, সেটাই এখানকার মাইগ্রেশন খরচ।’
সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভালো কিছু হয় না উল্লেখ করে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি একে আজাদ বলেন, ‘সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পক্ষে আমরাও আছি, যাতে এই সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে সবাই উন্মুক্তভাবে প্রতিযোগিতামূলকভাবে বিদেশে শ্রমিক পাঠাতে পারি।’
বায়রার সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘জনশক্তির এই খাত নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে নানা ষড়যন্ত্র চলছে। এই খাত ধ্বংস হয়ে গেলে দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। আজ শ্রমিকদের স্বার্থে অভিবাসন খাতে যারা কাজ করি, তাদের স্বার্থে একটি অভিন্ন নীতি থাকা প্রয়োজন। এখানে কোটা ব্যবস্থা তৈরি করে এই খাত ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র যারা করছে, তারা দেশের কল্যাণে কাজ করছে বলে আমরা মনে করি না।’
বায়রার সদ্য বিদায়ী কমিটির মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসনের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের যে অবস্থান, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমরা মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসন করতে চাই। বাংলাদেশ একটি বড় সোর্স কান্ট্রি। আমরা অনেক কথা শুনি; বলা হচ্ছে, মালয়েশিয়ার বাজারে এই ২৫ এজেন্সির সিন্ডিকেট চালু না করলে বাজার হারানোর শঙ্কা আছে। সত্য হচ্ছে, মালয়েশিয়ায় কোনো দেশ থেকে কর্মী যাচ্ছে না। সেখানে আমাদের দেশের কর্মী ছাড়া মালয়েশিয়ার সামনে পথ নেই। মালয়েশিয়ায় আমাদের কর্মীর ব্যাপক চাহিদা। কিন্তু মাঝখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কিছু মানুষ নিজের স্বার্থ হাসিলে এই শ্রমবাজার নষ্ট করছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে, যাতে কোনো চক্র এই বাজারে অস্থিরতা তৈরি করতে না পারে।’
সেন্টার ফর এনআরবির চেয়ারপারসন এমএস সেকিল চৌধুরী বলেন, ‘সেন্টার ফর এনআরবি প্রবাসীদের প্রয়োজনে যা কিছু প্রয়োজন, তা করে আসছে। বাংলাদেশের শ্রমবাজারকে যদি আমরা সুরক্ষা দিতে না পারি, বাংলাদেশের অর্থনীতি কিন্তু বিপজ্জনক অবস্থায় চলে যাবে। আজ রেমিট্যান্স না এলে ডলারের দাম যেটা ১০০ টাকা অতিক্রম করেছে, সেটি ১৫০ টাকা হতো। এর পেছনে যারা কারিগর, তারাই হচ্ছে এই রিক্রুটিং এজেন্সি। তাদের মাধ্যমে এদেশের মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। যার ফলে ২২-২৩ বিলিয়ন ডলার দেশে আসছে।’
অভিবাসন ও উন্নয়নবিষয়ক সংসদীয় ককাসের নির্বাহী কমিটির সভাপতি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘আমি মনে করি আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার জায়গা হচ্ছে বায়রা শক্তিশালী নয়। আপনারা প্রচুর মানুষ বিদেশে পাঠিয়েছেন, দেশের চালিকা শক্তিতে অবদান রেখেছেন, কিন্তু নিজেদের সংগঠনের মধ্যে ঐকমত্য আনতে পারেননি। আপনাদের নিজস্ব একটা উপলব্ধির সময় চলে এসেছে বলে আমি মনে করি।’ বায়রার সাবেক সভাপতি আবুল বাসার বলেন, ‘যারা সিন্ডিকেট করতে চায়, তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
গোলটেবিলে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাংবাদিক ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ শরিফুল হাসান। সেখানে তিনি বলেন, ‘গত ৪০ বছরে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলা ছিল ৬ থেকে ৭ বছর। প্রতিবারই দেখা যায়, আগের নিয়ম ভুল ছিল। আবার ভুল সংশোধন করতে গিয়ে আরও বেশি দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়। মালয়েশিয়ায় যখনই নির্বাচন আসে, তখনই বাংলাদেশ থেকে লোক নেওয়ার মাধ্যমে একটা ভালো ব্যবসা করার চেষ্টা করা হয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আবার চুক্তি হলো কর্মী পাঠানোর। আমরা আবার আশাবাদী হলাম। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, আবার ঘুরেফিরে সেই সিন্ডিকেটের আলোচনা। আমি জানি না, পৃথিবীর এমন কোনো ঘটনা আছে কিনা! মালয়েশিয়ার একজন মন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে চিঠি দিয়ে বললেন, ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সির বাইরে লোক নেব না। এটা একটা অদ্ভুত ঘটনা। মালয়েশিয়া অন্যান্য দেশ থেকে যেভাবে কর্মী নেয়, আর আমাদের এখান থেকে যেভাবে নেয়, পুরো প্রক্রিয়া আলাদা।’ তিনি বলেন, ‘শুধু মালয়েশিয়া নয়, আমাদের পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করতে হলে প্রযুক্তিবান্ধব পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে। এমন একটা পদ্ধতি থাকতে হবে, যেন যে কোনো বিদেশি নিয়োগকর্তা বাংলাদেশের সব বৈধ লাইসেন্সধারী রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে তাদের চাহিদা অনুযায়ী কর্মী সংগ্রহ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সব বৈধ লাইসেন্সধারী এজেন্সিকে একটি ডিজিটাল প্লাটফর্মে নিয়ে আসতে হবে।’
মূল প্রবন্ধের সুর ধরে বক্তারা বলেন, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে ২৫ জনের যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, সেটি ভেঙে ফেলতে হবে। এটি ভাঙতে না পারলে বিদেশে শ্রমবাজার আরও সংকীর্ণ হবে।
বাংলাদেশি ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সি সিন্ডিকেটের অপতৎপরতার কারণেই গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত চুক্তির কার্যক্রম স্থগিত ও বাংলাদেশিদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার আটকে আছে বলে অভিযোগ করেন তারা।
গোলটেবিল বৈঠকে অন্যদের মধ্যে বায়রার সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা, রিয়াজুল ইসলাম, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।