সিলেটবাসী এমন ভয়াবহ বন্যা দেখেনি বহু দিন। উজানের ঢল ও ভারি বৃষ্টিতে বন্যার স্রোতে ভেসে গেছে ঘর, আসবাবপত্র, গবাদিপশু; পানির সঙ্গে বাড়ছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার আলীরগাঁও গ্রামের ষাটোর্ধ্ব রমজান আলীর মনে পড়ে, এর আগে ২০০৪ সালে তাদের এলাকায় এমন বন্যা হয়েছিল। এবার পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় কি না, সেই শঙ্কায় আছেন তিনি। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, সিলেটের ১৩টি উপজেলার ৮৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। ৩২৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। কিন্তু সেখানেও বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকটের কথা বলছেন আশ্রয়গ্রহণকারীরা। পানিবন্দি মানুষগুলো চোখে অন্ধকার দেখছেন বলে ভাষ্য রমজান আলীর।
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পুর্ব রংপুর বস্তির বাসিন্দা রাশিদা বেগমের ঘর বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। চার সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ভাসুরের ঘরে। কিন্তু চার দিকে পানিঘেরা কাঁচা ঘর কখন ভেঙে যায়, এ শঙ্কায় তার ঘুম নেই। রয়েছে সাপের উপদ্রবও। রাশিদা বলেন, ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারি না। ঘরে সাপ চলে আসে। ঘরে খাবারও নেই। চার সন্তান নিয়ে বিপদে পড়ে গেছি। কোম্পানীগঞ্জের কাঁঠালবাড়ি সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় থানাবাজার আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন বৃদ্ধা রুমিনা আক্তার। হঠাৎ আসা ঢলে সব তলিয়ে যাওয়ায় অনেকটা শূন্য হাতে আশ্রয়কেন্দ্রে গেলেও সেখানেও স্বস্তিতে নেই তিনি। এক প্যাকেট চিড়া ও গুড় সাহায্য পেয়েছেন বলে জানালেন। বন্যায় সব কেড়ে নিয়েছে। এখন আশ্রয়কেন্দ্রে এসেও পেটের ক্ষিধা মিটছে না। সরকারি ত্রাণ সহায়তা অত পাচ্ছি না। গরীবের কোনো উপায় নেই। এখন সামনের দিনগুলোতে কীভাবে খেয়ে বাঁচব তা নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
হঠাৎ আসা পাহাড়ি ঢলে সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলো বেশি বন্যা কবলিত হয়েছে। সীমান্ত উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ, কানাইঘাটের বাসিন্দারা দুর্বিষহ দিন পার করছেন। সড়কে বন্যার পানি থাকায় মানুষের যাতায়াত বন্ধ। বন্ধ রয়েছে স্কুলগুলো। কানাইঘাটের লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়নের আব্দুল করিম বলেন, মহামারীর কারণে প্রায় দুই বছর স্কুল বন্ধ ছিল। এখন হঠাৎ বন্যার কারণে বিদ্যালয় বন্ধ। পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের সহকারী প্রকৌশলী নিলয় পাশা জানান, এ পর্যন্ত সিলেট জেলায় সুরমা-কুশিয়ারা নদীর ৩৪টি বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকেছে বিভিন্ন এলাকায়। তাতে সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার পর এবার বিয়ানীবাজার এবং গোলাপগঞ্জ উপজেলারও বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানি উঠেছে কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাট উপজেলা কমপ্লেঙে। এসব উপজেলার অনেক বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রেও পানি ওঠায় আশ্রিতরা বিপাকে পড়েছেন, বলেন নিলয়।
শুক্রবার সকাল ৯টায় সুমরা নদীর পানি কানাইঘাটে বিপৎসীমার ৯৮ সেন্টিমিটার, সিলেটে ৩৮ সেন্টিমিটার এবং সুনামগঞ্জে ষোল সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে গত এক দিনে ওই তিন পয়েন্টেই সুরমা নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, সুরমা-কুশিয়ারা ছাড়া দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ও হবিগঞ্জ জেলার নদীর পানির সমতল কিছু স্থানে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এই সময়ে সিলেট জেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে, তবে সুনামগঞ্জ জেলার নিম্নাঞ্চলের কিছু স্থানে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হতে পারে। বন্যাকবলিত মানুষের বড় সংকট খাবার পানি। টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার উপায় নেই।
জৈন্তাপুর উপজেলার ঘাটের ছটি গ্রামের আবুল হোসেন বলেন, টিউবওয়েলও পানির নিচে। বিদ্যুৎ নাই। খাবার পানিও নেই। বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়ে হাওরের পানিই খাচ্ছি, জীবনতো বাঁচাতে হবে। উপজেলাগুলোর মত সিলেট মহানগরেও খারাপ দিকে মোড় নিয়েছে বন্যা। বিদ্যুৎ না থাকায় পানির সংকটে পড়েছেন নগরবাসী। নিচু এলাকায় ঘরের ভেতর হাঁটু পানির কারণে রান্না করতে পারছেন না।
নগরীর তালতলা এলাকার বাসিন্দা আফজাল করিম জানান, গত তিন ধরে তার বাসায় বন্যার পানি। জরুরি কাগজপত্রসহ বিভিন্ন জিনিস নষ্ট হয়েছে। বাসায় পানি ওঠায় পরিবারের সদস্যদের আত্মীয়র বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। পাহারা দেওয়ার জন্য কাছের একটা আবাসিক হোটেলে উঠেছি আমি। এদিকে নগরীতে বন্যার পানি দুর্গন্ধ ছড়ানোয় ভোগান্তিতর কথা জানিয়েছেন উপশহর এলাকার রহমান মিয়া। তিনি বলেন, ঘরে কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরপানি। এর উপর বিদ্যুৎ নেই তিন দিন ধরে। জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
নগরীর শেখঘাট বস্তির বাসিন্দা অনামিকা দাশ বলেন, পুরো ঘরে জল। মাটির চুলা ছিল সেটাও তলিয়ে গেছে, রান্না করতে পারছি না। খাবার পানিও নেই। আমার এক আত্মীয় কিছু খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছিলেন, সেটাই কাল খেয়েছি। আজ রাতে কী করব জানি না। অনামিকার মত একই অবস্থা বন্যাকবলিত নগরীর বিভিন্ন এলাকার বস্তির মানুষদের। নগরীর যতরপুর এলাকার বাসিন্দা আজমল হোসেন জানান, বাসার সামনে পানির স্রোত বইছে। বাসা দোতলায় হওয়াতে রক্ষা পেয়েছেন। কিন্তু ঘর থেকে বের হলেই হাঁটুপানি। প্রতিনিয়ত পানি বাড়ছে। এত দ্রুত পানি বাড়তে আগে দেখিনি। পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মজিবর রহসান জানান, জেলার ১৩টি উপজেলার ৮৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। ৩২৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বর্তমানে ৯৫টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৭ হাজার ৩৪৯ জন আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। আশ্রিতদের শুকনো খাবার সরবরাহ ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সিলেট মহানগর ও উপজেলাগুলোতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য ১৩ লাখ টাকা, ২৩৪ মেট্টিকটন চাল, ৩ হাজার ৯৯ প্যাকেট শুকনো খাবার সরবরাহ করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জে ৩ হাসপাতালে পানি : পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে সুনামগঞ্জের তিনটি হাসপাতালে পানি ঢুকে গেছে; এর ফলে সেখানে সেবা ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। জেলা শহরের সুনামগঞ্জ বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, ছাতক উপজেলার কৈতক ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ও তাহেরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙের নিচতলায় পানি ঢুকে পড়েছে। কোথাও চিকিৎসকদের আবাসিক কোয়ার্টারও প্লাবিত হয়ে গেছে। এতে রোগী ও চিকিৎসক উভয়েই ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন।
সুনামগঞ্জে গত কয়েকদিন ধরেই টানা বৃষ্টি হচ্ছে। কখনও অঝোরধারায়, আবার কখনও গুড়িগুড়ি। এরই মধ্যে ঝড়-বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। গত ১০ দিন ধরেই এই অবস্থা চলছে জেলাজুড়ে। হাওর অধ্যুষিত এ জেলার সড়ক ও সেতু ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে কয়েক জায়গায়। পানি উঠে গেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও। পানিবন্দি মানুষকে আশ্রয় দিতে খোলা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র। বরাদ্দ করা হয়েছে শুকনো খাবার ও চাল।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামসুদ্দোহা বলেন, সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি এখনও বিপদসীমার উপরে আছে। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় সুরমার পানি সুনামগঞ্জ পয়েন্টে তিন সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে, সুরমা, কুশিয়ারাসহ এই অঞ্চলের প্রধান নদ-নদীর পানি আরও কিছু বাড়তে পারে। বৃষ্টিপাত ও ঢল অব্যাহত থাকলে পানি আরও বাড়বে। এতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটার আশঙ্কা করছে এলাকার মানুষজন।
M | T | W | T | F | S | S |
---|---|---|---|---|---|---|
1 | ||||||
2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 |
9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 |
16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 |
23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 |
30 | 31 |