দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় কমেছে মহামারী করোনার কারণে । অনেকে কাজ হারিয়েছেন। ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের দাম সারাবিশ্বে বেড়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের মার্চ মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক বছরে বিশ্বে গমের দাম বেড়েছে ৩৮ শতাংশ। গরুর মাংসের ৩৫ শতাংশ, মুরগির মাংসের ৫৫ শতাংশ, সয়াবিন তেল ৩৭ শতাংশ, চিনি ১১ শতাংশ, চা ১৩ শতাংশ, টিএসপি সার ৬৫ শতাংশ এবং ইউরিয়া সারের দাম বেড়েছে ২৩৪ শতাংশ। সেই উত্তাপ ছড়িয়েছে দেশের বাজারেও। চাল, আটা, তেল, চিনির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। এতে দরিদ্র ও দুস্থ জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন হয়ে উঠেছে আগের চেয়ে কষ্টের। এ পরিস্থিতিতে গরিব মানুষের জীবনযাপন সহজ করতে দেশের অর্থনীতিবিদরা খাদ্য ও নগদ সহায়তা বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। আগামী বাজেটে দরিদ্র মানুষের প্রতি নজর কিছুটা বাড়বে। বাড়ানো হবে মোট উপকারভোগীর সংখ্যাও।
এদিকে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আগামী বাজেট হবে সাধারণ মানুষের মঙ্গলের। দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে যা যা প্রয়োজন সব উদ্যোগ নেওয়া হবে। ৯ জুন বৃহস্পতিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে। গতকাল সচিবালয়ে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ও সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির ভার্চুয়াল সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এ কথা বলেন।
জানা গেছে, নানা প্রতিশ্রুতিসমৃদ্ধ ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জের বিষয়টি মাথায় রেখেই চূড়ান্ত করা হচ্ছে। টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে চায় আওয়ামী লীগ। এজন্য আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সরকার কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চায় না। ভোটাদের তুষ্ট রাখতে সরকার বাজেটে নানা খাতে ভর্তুকিতেও বরাদ্দ বাড়াচ্ছে। ইতোমধ্যে সংশোধিত বাজেটে ১২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বাজেটে আরও ১১ লাখ উপকারভোগীকে বয়স্কভাতার আওতায় আনার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে ১০০ উপজেলাকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। নতুন ১১ লাখসহ মোট উপকারভোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৬৮ লাখ। এতে সরকারের ব্যয় বাড়বে ৫০০ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে ৫৭ লাখ উপকারভোগী বয়স্কভাতা পাচ্ছেন। চলতি অর্থবছরে বাজেটে বয়স্কভাতার জন্য বরাদ্দ রয়েছে তিন হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৩ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের ১১২ উপজেলায় বয়স্কভাতা দেওয়া হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে দরিদ্রপ্রবণ আরও ১৫০ উপজেলার বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত নারীকে ভাতার আওতায় আনা হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই ১৫০ উপজেলার সঙ্গে আরও ১০০ উপজেলা যুক্ত হচ্ছে। ফলে দেশের ৩৬২ উপজেলার বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত নারীরা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আসছেন।
জানা গেছে, আগামী বাজেটে দ্রব্যমূল্য কমাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে কর ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি, দারিদ্র্য দূরীকরণে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো এবং অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প গ্রহণ থেকে সরে আসার মতো পদক্ষেপ গ্রহণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। তবে পদ্মা সেতু দ্রুত চালুসহ বাজেটে মেগা দশ প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করে আনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। করোনার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে চলমান প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের কাজ চলবে। তবে সার্বিক স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ানো হলেও করোনার জন্য পৃথক কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে না। দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
জানা গেছে, আগামী বাজেটে দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়ানো হবে। বিশেষ করে নতুন করে বয়স্ক ও বিধবাভাতা দিতে দেশের আরও ১০০ উপজেলার নাম চূড়ান্ত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ সংকট দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এ আশঙ্কায় দেশে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি ৪ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার বাজারে ছেড়েছে। তবে ব্যাপকভাবে ডলারের ব্যবহার কমাতে অপ্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি খোলার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। বিদ্যুৎ, সার ও এলএনজিতে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দেওয়া হবে আগামী বাজেটে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদান সক্ষমতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, করোনা সংক্রমণ কমে আসায় আগামী বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, যা ৪৪ লাখ ১৭ হাজার ১০০ কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। এ লক্ষ্যে বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে যা রয়েছে ৬ দশমিক ১ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছর আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে আয় বাড়ছে ৪৮ হাজার কোটি টাকা।
সচিবালয়ে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ও সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির ভার্চুয়াল সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, আমাদের রপ্তানির পাশাপাশি আমদানিও বাড়ছে। এটা বন্ধ করা যাবে না। তবে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণের কোনো ইচ্ছা সরকারের নেই। তিনি বলেন, বাজেট প্রণয়নের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ডিজিটাল কানেকটিভিটি প্রকল্প সম্পর্ক জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ প্রজেক্টটি আমাদের বিবেচনায় ভালো প্রকল্প। সেখানে অনেক জনবল কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে। গণমাধ্যমে এসেছে করোনার মধ্যে দেশে ১ লাখ মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছে ই-কমার্সে। একই খাতে চলতি বছরে আরও ৫ লাখ মানুষ কর্মসংস্থান হারাবে। আমরা যে প্রকল্পগুলো অনুমোদন দিই সেক্ষেত্রে দুটি জিনিস বিবেচনা করি। মৌলিক দুটি এলাকা বিবেচনা করি, রেভিনিউ জেনারেশন ফর গভর্নমেন্ট এবং কর্মসংস্থান। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে অনেক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ টাকা আছে, আসছে বাজেটে এটা বাড়ানোর কথা বিবেচনা করছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের আইটেম ওয়াইজ আলোচনা আরও করতে হবে। এনবিআর আছে, তাদের সঙ্গে বসতে হবে। নিজস্ব মন্ত্রণালয়ের বিভাগ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা বাজেট তৈরি করব।
বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে। আরও নিয়ন্ত্রণের চিন্তাভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, আমাদের অনেক রকম পণ্য আমদানি আছে। একটা আমদানি হচ্ছে প্রজেক্টের সঙ্গে সরাসরি রিলেটেড, সেটা আমরা অ্যালাই করি।
সম্প্রতি বাজেটসংক্রান্ত এক বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, করোনা মহামারী থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যবসাবান্ধব বাজেট প্রণয়নে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। কর বাড়াতে হলে আগে হয়রানি বন্ধ করে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ দিতে হবে।