শেখ হাসিনা বলেন, কালকে দেখলাম, উনি (খালেদা জিয়া) জন্মদিন পালন করবেন না। তার জন্মদিন এই তারিখে না। শুধু আমাদের আঘাত দেয়ার জন্য তিনি এদিন জন্মদিন পালন করতেন, যে দিনটাতে আমরা শোকে কাঁদি। উনার জন্মদিন পালন না করাকে কেউ কেউ তার রাজনৈতিক উদারতা বলে দেখাতে চাচ্ছেন। কিন্তু আসল ঘটনাটা কী সেটা তো আমি জানি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১২ই আগস্ট তার ছেলে কোকোর জন্মদিন। ছেলে মারা গেছে। কাজেই কোকোর জন্মদিন যেহেতু করতে পারবে না, তাই নিজেরটা করবে না। এখানে কোনো রাজনৈতিক উদারতা নেই। এটা হল বাস্তব কথা। তিনি আরও বলেন, আর এটা তো তার জন্মদিন না। পাসপোর্টে তার অন্য তারিখ রয়েছে। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জীবন বৃত্তান্তে অন্য তারিখ রয়েছে। কিন্তু উনি শুধু বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার জন্য, আর আমাদের আঘাত দেয়ার জন্য এই দিনটাকে বেছে নিয়েছিল ফুর্তি করার জন্য।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল সেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করে দেয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। মাত্র ১৫ দিন আগে ১৯৭৫ সালের ৩০শে জুলাই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে দেশ ছেড়েছিলাম। জানি না কেন? সেদিন মায়ের কী আকুল কান্না! আজও ভুলতে পারি না। মাকে এভাবে কান্না করতে কখনও দেখিনি। জানিনা মা হয়তো সেদিন বুঝতে পেরেছিলেন- হয়তো এটা শেষ দেখা, তাই হয়তো এতো কেঁদেছিলেন। ১৩ই আগস্ট মায়ের সঙ্গে শেষ কথা। মা বলেছিলেন, তুই আয়, তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে। মায়ের সেই কথা আর শোনা হয়নি। বাবার সঙ্গে শেষ কথা হয় ১৪ই আগস্ট। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৫ই আগস্ট ভয়াল রাত্রির কথা যুগোশ্লোভিয়া থেকে শোনা। বাংলাদেশে ক্যু হয়েছে। তখন আমার মুখ থেকে বের হলো- তাহলে তো কেউ বেঁচে নেই। স্মৃতিতাড়িত হয়ে তিনি বলেন, তখন বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূত ছিল একজন। তাকে রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৫ই আগস্টের পরে ওই রাষ্ট্রদূতের কাছে আমরা বোঝা হয়ে গেলাম। আমরা বেলজিয়াম থেকে জার্মানি যাওয়ার জন্য তার গাড়ি সহযোগিতাও পাইনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই রাষ্ট্রদূতের কাছে গাড়ি সহযোগিতা চাইলে তিনি বলেন, তার গাড়ি নষ্ট। অবশ্য তখনও আমরা জানিনা, আমাদের এত বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে।
পঁচাত্তর ট্রাজেডির পর প্রবাসে নিজের স্মৃতির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জার্মান থেকে ২৪শে আগস্ট আমরা গেলাম ভারতে। ৪-৫ সেপ্টেম্বর ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা হলো- উনার মুখ থেকে শুনলাম কেউ নেই আমাদের। কিন্তু কেন যেন ভাবলাম রাসেল আছে! সিদ্ধান্ত নিলাম দেশে আসব। কিন্তু আসতে পারব না। জিয়া খবর পাঠালো কিছুতেই আমরা দেশে আসতে পারব না। তারপর রাজনৈতিক আশ্রয়ে থেকে গেলাম ভারতে। এরই মধ্যে লন্ডনে রেহানার (বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা) বিয়ে ঠিক হলো। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বেঁচে থাকা একমাত্র বোন, আমি তার বিয়েতে যেতে পারিনি। কারণ, সে সময় টিকিটের টাকা, সেখানে থাকা, খাওয়ার-সুযোগ আমাদের ছিল না। কোথায় থাকব? আমি একমাত্র বোন হয়েও তার বিয়েতে থাকতে পারিনি। এ সময় তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকে হাত পাতার স্বভাব ছিল না। কষ্ট বুকে চেপে রেখেছি, কাউকে প্রকাশ করিনি।
দেশে ফেরার স্মৃতিচারণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ’৮১ সালে বিমানবন্দর থেকে ৩২ নম্বরের বাড়িতে আসি। কিন্তু আমাকে ঢুকতে দেয়নি। জিয়াউর রহমান ওই বাড়ি আমার জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। বড় তালা ঝুলানো ছিল। পরে ৩২ নম্বরের বাড়ির সামনে রাস্তায় মিলাদ, দোয়া ও মোনাজাত করে ফিরে আসি। জিয়া যত দিন বেঁচে ছিল ওই বাড়িতে আমাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। অবশ্য জিয়া আমাকে অনেক বাড়ি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি নেইনি। তিনি বলেন, ৩০শে মে জিয়া মারা যাওয়ার পর ১২ই জুন দুপুরে হঠাৎ ৩২ নম্বরের বাড়ি আমাকে হস্তান্তর করা হবে। তখন আমার ছোট ফুফা বলেন আইনজীবীর মাধ্যমে এ বাড়ি নিতে হবে। তখনও জানি না কেন এত তাড়াহুড়ো। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৩২ নম্বরের বাড়িতে যখন যাই আমি ভেতরে ঢুকতে পারছিলাম না। বাড়ির ভেতরে সিঁড়ি বেয়ে যখন উঠি, অর্ধেক সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই আমি চিৎকার করে উঠি, জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। সঙ্গে রেহানাও ছিল না। অর্ধচেতন অবস্থায় বাড়ির ভেতরে নিয়ে আমার কাছ থেকে অনেকগুলো কাগজে স্বাক্ষর নেয়। পরে বুঝলাম ঠিক যেভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার আগে তার বিরুদ্ধে আমাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যের বিরুদ্ধে বদনাম, চরিত্রহনন, অপপ্রচার তার আরেকটা পর্ব শুরু হলো বাড়ি হস্তান্তর করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে ওই বাড়িতে লুটপাট করা হয়েছে। ৬ বছর পর আমার কাছে বাড়ি হস্তান্তর করা হয়েছে। কী থাকতে পারে আর সেই বাড়িতে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আকাঙ্ক্ষা পূরণই আমার একমাত্র প্রতিজ্ঞা। ১৫ই আগস্টের পর থেকে এই দেশ ২১ বছর শোষিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত হয়েছে। আমি সব হারিয়েছি। কিন্তু সব হারাবার বেদনা নিয়েও একটা শক্তি নিয়ে কাজ করি, বড় সন্তান হিসেবে। এই দেশকে নিয়ে, দেশের মানুষগুলোকে নিয়ে আমার বাবার যে স্বপ্নগুলো ছিল তা জানার এবং বোঝার সুযোগও ছিল। শুধু একটা কথাই মনে করি, এই কাজগুলো করলে, দেশের মানুষগুলো ভালো থাকলে, আমার আব্বার আত্মা শান্তি পাবে। আমার ইচ্ছা এই নির্যাতিত নিপীড়িত ক্ষুধার্ত মানুষদের যেন এতটুকু সেবা করতে পারি। তারা যদি একটু ভালো থাকে। আমি জানি, এতেই আমার আব্বার আত্মা খুশি হবে, শান্তি পাবে।
তিনি বলেন, শুধু একটা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। আর কোন আকাঙ্ক্ষা আমার নেই। যে মানুষগুলোর জন্য বাবা জীবন দিয়ে গেলেন, আমার মা জীবন দিলেন, আমার ভাইয়েরা জীবন দিল- সেই মানুষগুলোর ভাগ্য পরিবর্তন করা। আজকে আস্তে আস্তে মানুষের ভাগ্য পরিবতর্ন হচ্ছে। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে। অনেক আঘাত আসছে। আরও হয়তো আসবে। কখনো সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ, খুন, গ্রেনেড হামলাসহ অনেক কিছুই মোকাবিলা করতে হয়েছে। শুধু একটা সাহস নিয়ে চলি। যে সাহসটা আমার বাবা-মার কাছ থেকে পেয়েছি। মানুষের জন্য কাজ করছি। জনগণের জন্য কাজ করছি। তাদের কল্যাণে কাজ করছি। এখানে কোনো ব্যক্তিস্বার্থ নেই।
তিনি বলেন, বাবা এ দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাকে করতে দেয়া হয়নি। এই ১৫ই আগস্ট তাকে কেড়ে নেয়া হলো। তার যে আকাঙ্ক্ষা তা আমাকে পূরণ করতে হবে। এটাই আমার একমাত্র প্রতিজ্ঞা। দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তার স্বপ্নের সোনার বাংলা আমরা গড়বো। তবেই তার আত্মা শান্তি পাবে। খুনিদের বিচার করেছি। বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। একটাই কাজ দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলা। আজকের দিনে সেই প্রতিজ্ঞাই নিচ্ছি। পিতাকে সেই কথাই দিচ্ছি।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে স্মরণসভায় আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এসএম কামাল হোসাইন প্রমুখ। স্মরণসভায় শোকাবহ আগস্ট নিয়ে কবিতা আবৃত্তি করেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ আলম লেনিন এবং সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। সভা যৌথভাবে সঞ্চালনা করেন প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ও উপ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিল
M | T | W | T | F | S | S |
---|---|---|---|---|---|---|
1 | 2 | 3 | 4 | 5 | ||
6 | 7 | 8 | 9 | 10 | 11 | 12 |
13 | 14 | 15 | 16 | 17 | 18 | 19 |
20 | 21 | 22 | 23 | 24 | 25 | 26 |
27 | 28 | 29 | 30 | 31 |