কম জনবসতিপূর্ণ এলাকা বর্তমানে ঢাকার পূর্বাঞ্চলে। এর নগরায়ণ হবে। এই পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণমুখী যোগাযোগ হবে সহজ। এজন্য নির্মাণ করা হবে ৭৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বাস র্যাপিড ট্রানজিট। তবে এর দুই পাশে থাকবে এক্সপ্রেসওয়ে। এর নাম হবে বিআরটি-৭। এতে করে ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক যুক্ত হবে।
চাষাড়া থেকে সাইনবোর্ড, ডেমরা, বনশ্রী, মাদানী এভিনিউ, আফতাবনগর, পূর্বাচল, মীরেরবাজার, পুবাইল, রাজেন্দ্রপুর হয়ে কাপাসিয়া পর্যন্ত হতে পারে। প্রস্তাবিত অ্যালাইনমেন্টে এক্সপ্রেসওয়ের মাঝখানে থাকবে বিআরটি। ৭৭ কিলোমিটার বিআরটি অ্যালাইনমেন্টে ৮১টি বিআরটি স্টেশন থাকবে। ১৫টি ট্রানজিট ইন্টারচেঞ্জ এবং ছয়টি মহাসড়ক ইন্টারচেঞ্জ থাকবে। এর মধ্যে ১৮টি হবে গ্রেড সেপারেটেড ইন্টারচেঞ্জ। মাঝে রাখা পাঁচ মিটারের বিভাজকে ভবিষ্যতে মেট্রোরেল নির্মাণ করলে ঘণ্টায় ৮০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। ১০ লেনের এক্সপ্রেসওয়ে ও তার মাঝ বরাবর বিআরটি লেন নির্মাণে
লাগবে প্রায় ৩৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বিআরটি লেন নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় আট হাজার ৪০০ কোটি টাকা। প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় পড়বে ১০৯ কোটি টাকা। ১০ লেনের এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণে বাকি প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা লাগবে। চার ধাপে ২০২৪ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে বিআরটি-৭ নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে প্রস্তাবিত সমীক্ষায়।
২০২৪ সালের মধ্যে নির্মাণাধীন ছয় লেনের লিংক রোড হয়ে চাষাড়া থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত বিআরটি লেন ও এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় হবে আড়াই হাজার কোটি টাকা। ২০২৬ সালের মধ্যে সাইনবোর্ড থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে ও বিআরটি লেন নির্মাণে লাগবে আট হাজার ২০০ কোটি টাকা। ২০২৭ সালের মধ্যে গাজীপুর পর্যন্ত বিআরটি নিতে দরকার হবে ১১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ২০৩০ সালের মধ্যে কাপাসিয়ায় পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে ও বিআরটি নিতে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। তবে বিআরটি-৭ এর সঙ্গে ঢাকার চারদিকে বৃত্তাকার রেলপথ ও পাতাল রেল (সাবওয়ে) প্রকল্প সাংঘর্ষিক।
সড়ক সচিব নজরুল ইসলাম এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তবে এখনো অ্যালাইনমেন্ট চূড়ান্ত হয়নি। কোন রুট ধরে করা যায় সমীক্ষা রিপোর্ট ধরে মতামত নেওয়া হয়েছে। আরও পর্যালোচনা বাকি। বৈদেশিক ঋণ অর্থায়ন পাওয়াসাপেক্ষে পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত হবে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, বিআরটি-৭ এর উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। এ সংক্রান্ত সমীক্ষা ইতোমধ্যে করা হয়েছে। আমার মতে, ওই অঞ্চলে কী পরিমাণ যাত্রীর চাহিদা রয়েছে তা সমীক্ষায় পুরোপুরি আসেনি। এটি প্রাধান্য দিতে হবে। একই করিডোরে ২০১৬ সালে মেট্রোরেল করার কথা ছিল। এখন বিআরটির কথা আসছে। তাছাড়া সাবওয়ে, সার্কুলার রেলসহ পৃথক সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। ভারী যান চলাচলের জন্য বিআরটির ভালো উদ্যোগ। আমার মতে, সমন্বিত যাত্রী চাহিদার মডেল দরকার। ধরুন, পিপিপির উদ্যোগে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে। সেটি যুক্ত হবে কুতুবখালীতে। এখন বিআরটির কারণে উড়াল সড়কের ট্রাফিক কমলে ভর্তুকি দিতে হবে। কারণ বিনিয়োগকারীর সঙ্গে সে রকম চুক্তি আছে। তাছাড়া বিপুল বিনিয়োগ করে এ রকম প্রকল্প হাতে নেওয়া হলে অন্য অবকাঠামোয় এর প্রভাব পড়বে কিনা। এত সব প্রকল্পের মধ্যে কোনটিতে কী পরিমাণ যাত্রীর ধারণ ক্ষমতা এবং চাহিদা কেমন তাও স্টাডি করা জরুরি। অন্যথায় উদ্যোগের সুফল নাও মিলতে পারে।
সূত্র মতে, জমি অধিগ্রহণ প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় বাধা। প্রস্তাবিত সমীক্ষায় নির্মাণ ব্যয় কমাতে জমি অধিগ্রহণ না করে প্রকল্প এলাকার ভূমি মালিকদের সঙ্গে অংশীদারত্বে প্রকল্প বাস্তবায়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিআরটি স্টেশন এলাকায় ট্রান্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) করবে সরকার। বাণিজ্যিক স্থাপনা অবকাঠামো থাকবে টিওডিতে। সরকার ও ভূমি মালিকের মধ্যে তা ভাগ হবে।
সরকারের সংশোধিত পরিবহন পরিকল্পনায় ঢাকার পূর্বাঞ্চলের কম জনবসতিপূর্ণ এলাকার নগরায়ণ এবং উত্তর-দক্ষিণমুখী যোগাযোগ বাড়াতে গাজীপুরের পুবাইল থেকে চাষাড়া পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার বিআরটি-৭ নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নযোগ্য কিনা তা যাচাইয়ে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ২০১৮ সালে সরকারি অর্থায়নে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শুরু করে। চার কোটি ৮৯ লাখ টাকা ব্যয়ে সমীক্ষা করা হয়েছে। ব্রিটিশ পরিবহন প্রকৌশলী রবার্ট গেলাঘেরের নেতৃত্বাধীন দল এ সমীক্ষা করেছে। ওই সমীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে।
বলা হয়েছে, আরএসটিপি অনুযায়ী চাষাড়া থেকে পুবাইল পর্যন্ত বিআরটি-৭ নির্মাণ সঠিক হবে না। কারণ, নির্মাণ এলাকা জলাভূমি ও কম জনবসতিপূর্ণ। তাই ছয়টি বিকল্প আল্যাইনমেন্ট নির্ধারণ করা হয়। চাষাড়া থেকে সাইনবোর্ড, ডেমরা, বনশ্রী, মাদানী এভিনিউ, আফতাবনগর, পূর্বাচল, মীরেরবাজার, পুবাইল, রাজেন্দ্রপুর হয়ে কাপাসিয়া অ্যালাইনমেন্টটি ড্যাপের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই অ্যালাইনমেন্টে বিআরটি-৭ হলে তা ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে যুক্ত হবে। ঢাকার পূর্বাঞ্চলে নগরায়ণ হবে। তুলনায় কম জলাভূমি ও কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখান দিয়ে মেট্রোরেল না করারও যুক্তি দেখানো হয়েছে।
সমীক্ষা অনুযায়ী এক্সপ্রেসওয়ে থাকবে রাস্তায়। মাঝ বরাবর রাখা হবে বিআরটি লেন। যে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে, তা হবে দুই পাশে তিন লেন করে মোট ছয় লেনের। ২১ মিটার বা প্রায় ৬৯ ফুট প্রশস্ত এক্সপ্রেসওয়েতে চলতে টোল লাগবে। এক্সপ্রেসওয়ের দুই পাশে সাত মিটার করে দুই লেন করে মোট চার লেন সড়ক থাকবে টোল ছাড়া যান চলাচলে। অযান্ত্রিক যান চলাচলে ১০ লেনের দুই পাশে আড়াই মিটার করে লেন এবং পথচারীর জন্য আড়াই মিটার প্রস্থের ফুটপাত থাকবে। প্রায় পাঁচ কোটি টাকায় করা সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বিআরটি এবং এক্সপ্রেসওয়েতে ঘণ্টায় ১৫ হাজার করে মোট ৩০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা যাবে।
প্রস্তাব করা হয়েছে, বিআরটি লেনের মাঝে পাঁচ মিটারের সড়ক বিভাজকসহ এক্সপ্রেসওয়ে ৫৭ দশমিক ৫ মিটার বা ১৯০ ফুট প্রশস্ত হবে। দুই পাশে ৩০ ফুট করে জায়গা খালি রাখা হবে। সব মিলিয়ে ২৫০ ফুট প্রশস্ত এক্সপ্রেসওয়ে ও বিআরটির জন্য এক হাজার ২৬৬ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে।
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, মেট্রোরেল প্রকল্প এমআরটি-১ এবং এমআরটি-৫ এর স্টেশন এলাকার জমির দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ বিলিয়ন ডলার। এতে জমি মালিকরা লাভবান হলেও সরকার বর্ধিত দামের মাত্র ৪ শতাংশ পেয়েছে। বিনিয়োগ দ্রুত তুলে আনতে বিকল্প হিসেবে বলা হয়েছে, বিআরটি করিডোরের দুই পাশে ৫০০ মিটার করে এক কিলোমিটার এলাকায় উন্নয়ন কর নির্ধারণ করা যেতে পারে। ফলে জমি মালিকদের সঙ্গে সরকারেরও লাভ হবে। তাছাড়া বিআরটি স্টেশন এলাকায় টিওডি নির্মাণ ছাড়াও স্টেশন ও ইন্টারচেঞ্জ এলাকার ভূমি উন্নয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, সাইনবোর্ড ও ডেমরা এলাকায় ৫৫ একর জমি অধিগ্রহণে বর্তমান বাজার দরে দেড় হাজার কোটি টাকা লাগবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে ৪৫ শতাংশ ভূমিকা রেখে বাকি জমি চার হাজার ১১৮ কোটি টাকায় প্লট আকারে বিক্রি করা সম্ভব। এতে সরকারের দুই হাজার ৬১৮ কোটি টাকা লাভ হবে। জমি অধিগ্রহণ ও তা উন্নয়ন মূল চ্যালেঞ্জ। এ কারণে পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে রাজউকের মাধ্যমে বিআরটি-৭ প্রকল্প বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে সমীক্ষায়।
জানা গেছে, গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার বিআরটি-৩ করার কথা। এর অর্ধেক অর্থাৎ জয়দেবপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত নির্মাণ কাজ চলছে। ১০ বছরেও এর শেষ হয়নি। নির্মাণ ব্যয় ২ হাজার ৩৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে যাচ্ছে। নির্মাণকাজে টঙ্গী-জয়দেবপুর সড়ক যানজটে প্রায় প্রতিদিন স্থবির থাকছে। তবে সমীক্ষা অনুযায়ী বিআরটি-৭ অ্যালাইনমেন্টে মেট্রোরেলের চেয়ে বিআরটির যাত্রী পরিবহন ক্ষমতা কম হলেও নির্মাণ ব্যয়ও অনেক সস্তা। ৭৭ কিলোমিটার বিআরটি-৭ নির্মাণে সাড়ে ৩৪ হাজার কোটি টাকা লাগতে পারে। কিন্তু ২৪ কিলোমিটার এমআরটি-১ নির্মাণে প্রায় ৫০ হাজার কোটি এবং ২০ কিলোমিটার এমআরটি-৫ নির্মাণে সাড়ে ৪২ হাজার কোটি টাকা লাগছে।