রাজধানী ঢাকার মানুষ নির্মল বায়ু সেবন করেছে সেটি গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এখন সারা বছরই মারাত্মক বায়ুদূষণের মধ্যে থাকতে হচ্ছে রাজধানীবাসীদের। ফলে ‘নির্মল বায়ু’ যেন এখন ঢাকাবাসীর কাছে শুধুই কথার কথা।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণা বলছে, গত ছয় বছরে অর্থাৎ ২১৯০ দিনে মাত্র ৩৮ দিন বিশুদ্ধ বায়ু পেয়েছে ঢাকার মানুষ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছয় ধরনের পদার্থ এবং গ্যাসের কারণে ঢাকায় দূষণের মাত্রা সম্প্রতি অনেক বেড়ে গেছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা অর্থাৎ পিএম ২.৫ এর কারণেই ঢাকায় দূষণ অতিমাত্রায় বেড়ে পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠছে। গত বছর ঢাকা শহরের সবচেয়ে বেশি দূষিত এলাকা ছিল তেজগাঁও। এখানকার বাতাস প্রতি ঘনমিটারে ৭০ মাইক্রোগ্রাম সুক্ষ্ম ধূলিকণা পাওয়া গেছে। পরের অবস্থানে রয়েছে শাহবাগ, এখানে বাতাসের প্রতি ঘনমিটারে সুক্ষ্ম ধূলিকণা মিলেছে ৬৮ মাইক্রোগ্রাম। এ ছাড়া শহরের প্রত্যেকটি স্থানের বাতাসেই গড় বস্তুকণা ছিল নির্ধারিত মানমাত্রার কয়েকগুণ বেশি।

ক্যাপসের তথ্য বলছে, ঢাকা শহরে বিকাল ৪টার পর থেকে বায়ুদূষণের মান খারাপ হতে শুরু করে, যা রাত ১১টা থেকে ২টার মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে। গত ছয় বছরে গড় বায়ুর মান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাত ১টায় ঢাকায় বায়ুমান সূচক ছিল ১৬২, যা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সর্বোচ্চ। রাত ১০টার পর উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ থেকে অনেক মালবাহী ট্রাক ঢাকায় প্রবেশ করে। এসব যানবাহন থেকে রাতে ব্যাপক বায়ুদূষণ হয়।

এদিকে রাজধানীর বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে আদালতের দেওয়া একাধিক নির্দেশনা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ না নেওয়ায় আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার প্রশাসকদের ভার্চুয়ালি সংযুক্ত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি জেলাগুলোর অবৈধ ইটভাটার তালিকা দাখিলেরও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। ঢাকা শহর ও আশপাশের এলাকায় বায়ুদূষণ বন্ধে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট করে। এর পর ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে কয়েক দফা নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট।

নির্দেশনাগুলো হলো- বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন হওয়ার পর তাদের মতামত বিবেচনায় নিয়ে বায়ুদূষণ বন্ধে ঢাকা শহরের বিভিন্ন নির্মাণাধীন এলাকায় মাটি/বালি/বর্জ্য ঢেকে রাখা, সিটি করপোরেশন কর্তৃক রাস্তায় পানি ছিটানো, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি কাজে টেন্ডারের শর্ত পালন নিশ্চিত করা, কালো ধোঁয়া নির্গমনকারী যানবাহন জব্দ ও অবৈধ ইটভাটাগুলো বন্ধ করা। তবে এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়ায় গত ৩০ জানুয়ারি হাইকোর্টে একটি সম্পূরক আবেদন দাখিল করা হয়। ওই আবেদনের সঙ্গে ঢাকার বর্তমান দূষণের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অবস্থান ও অবৈধ ইটভাটা পরিচালনা সম্পর্কে মিডিয়ার সংবাদ সংযুক্ত করে চাওয়া হয় ৪ দফা নির্দেশনা। এর আগে রাজধানীতে বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালে একাধিকবার হাইকোর্ট হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, হাইকোর্টের কয়েক দফা নির্দেশনা বাস্তবায়িত না হওয়ায় বায়ুদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। মিডিয়ায় রিপোর্টে এসেছে, অবৈধ ইটভাটা প্রশাসনের সামনে পরিচালিত হচ্ছে, কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এমনকি মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময় করে মালিকরা অবৈধভাবে সাভার, ধামরাইয়ে ইটভাটা চালাচ্ছেন। আটবার আদালত বিভিন্নভাবে নির্দেশনাগুলো দেওয়ার পরও সংশ্লিষ্টরা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় নাগরিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। আমি মনে করি, পরিবেশদূষণ রোধ করা যাদের দায়িত্ব, তাদের অবহেলার কারণেই তা সম্ভব হচ্ছে না।

পরিবেশ অধিদপ্তরে নির্মূল বায়ু ও টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পের বাতাসের মান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে ১৬৫ দিন রাজধানীর বায়ু বিপজ্জনক পর্যায়ে ছিল। পর্যায়ক্রমে দূষণের মাত্রা বাড়ছে। ২০১৫ সালে দূষণের মাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৮ দিন। এর পর ২০১৬ সালে দূষণ ছিল ১৯২ দিন। আর ২০১৭ সালে ২১২ দিন পর্যন্ত দূষণের কবলে ছিল ঢাকার মানুষ। এর পর ২০১৮ সালের ২৩৬ দিনই ছিল ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা চরম বিপজ্জনক। ২০১৯ সালে ২৮৩ দিন দূষণের কবলে থাকে ঢাকার মানুষ। ২০২০ ও ২০২১ সালে প্রায় সারাবছরই বায়ুদূষণের কবলে ছিল ঢাকা।

গবেষকরা বলছেন, চলমান মেগা প্রকল্প, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, নির্মাণাধীন স্থাপনা, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, ইটভাটা, বসতবাড়ি ও কলকারখানার বর্জ্যসহ নানাবিধ কারণে ঢাকার বাতাস দূষিত হচ্ছে। এসবের ফলে রাজধানীর বাতাসে যুক্ত হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সিসা, নাইট্রোজেন, হাইড্রোকার্বন, বেনজিন, সালফার ও ফটোকেমিক্যাল অক্সিডেন্টস। জ্বালানির দহন, বনভ‚মি উজাড় প্রভৃতি কারণে বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। ঢাকার এমন বায়ু স্বাস্থ্যের ওপর নানাভাবে প্রভাব ফেলছে। ফুসফুসের নানা রোগ, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন জটিলতায় পড়ছেন নগরবাসী।

ক্যাপসের গবেষণায় দেখা যায়, রাজধানীর তেজগাঁও, আগারগাঁও, মিরপুর-১০, গুলশান-২, শাহবাগ, ধানমন্ডি-৩২ এবং আবদুল্লাহপুর এলাকায় গড় মাসিক পিএম ২.৫-এর ঘনত্ব বেশি। মূলত যেসব এলাকায় বিভিন্ন শিল্পকারখানার উপস্থিতি রয়েছে, রাস্তা নির্মাণ ও মেরামতের কাজ ও মেট্রোরেলের কাজ চলমান এবং কয়েকটি রাস্তার সংযোগ যেখানে ঘটেছে, সেখানে পিএম ২.৫-এর ঘনত্ব বেশি।

এ বিষয়ে ক্যাপস পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি, আইনের দুর্বলতা, আইন প্রয়োগে সীমাবদ্ধতা ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। গত জানুয়ারি মাসে ঢাকার মানুষ একদিনের জন্যও ভালো বায়ু গ্রহণ করতে পারেনি। বায়ুর মান বেশিরভাগ সময় অস্বাস্থ্যকর থেকে খুবই অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় ছিল। শিল্পকারখানার দূষণ, রাস্তা নির্মাণ ও মেরামতের কাজ, ইটভাটা এবং যানবাহনের দূষণ বেড়ে যাওয়া বড় কারণ। সঙ্গে বায়ুদূষণ রোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের টেকসই, সমন্বিত, বিজ্ঞানভিত্তিক ও অংশীদারমূলক পদক্ষেপের অভাব রয়েছে।

বায়ুদূষণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব তুলে ধরে শ্যামলী টিবি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, বায়ুদূষণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুভাবেই আমাদের ক্ষতি করে। প্রথমত সরাসরি ফুসফুস আক্রান্ত হওয়ায় শ্বসনতন্ত্রের নানাবিধ সংক্রামক ব্যাধি হয়। বায়ুতে থাকা নানা মাত্রার পার্টিকেল বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা রক্তে মিশে যাওয়ায় ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে। আবার লিভার, কিডনি ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কমে যায় এসব অঙ্গের কার্যক্ষমতা। আমরা দেখতে পেয়েছি, বায়ুদূষণ বাড়লে ফুসফুসজনিত রোগের প্রকোপ বাড়ে। বায়ুদূষণ কমলে এসব রোগের প্রকোপও কমে। আয়েশা শিল্পী সবাইকে মাস্ক পরার ওপর জোর দেন। তা হলে করোনার পাশাপাশি বায়ুদূষণ জনিত রোগ থেকেও রক্ষা পাওয়া যাবে।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031